নিখুঁত অপরাধের একরারনামা
সিরিজ়: রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ় (সিজ়ন ২)
পরিচালনা: অভিরূপ ঘোষ
অভিনয়ে: রুদ্রনীল ঘোষ, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শাঁওলী চট্টোপাধ্যায়, রাজদীপ গুপ্ত, মণিশা সেন, কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি, অরণ্য রায় চৌধুরী
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৩৮ মিনিট (৬ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
ঝন্টু মোটর গ্যারেজের সঙ্গে দর্শকরা পরিচিত হয়েছিলেন এই সিরিজ়ের প্রথম সিজ়নে। তবে এবার আর শুধু গাড়ি চুরি নয়, এই সিজ়নের মূল লক্ষ্যই হলো অন্ধকার অপরাধজগৎকে আরো বিস্তৃতভাবে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসা। এই অপরাধ কোনও মোটা দাগের অপরাধ নয়। সব অপরাধই এবার সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত।
প্রথম সিজ়নেই বেশ কিছুটা রহস্য তৈরি করেছিল ঝন্টু মোটরসের কর্ণধার ঝন্টুদা (রুদ্রনীল)। অপরাধক্ষেত্রে ঠান্ডা মাথার নেতাসুলভ ঝন্টুর উত্থান দেখনোর জন্য অভিরূপ দর্শককে কখনও নিয়ে গেছেন সত্তরের দশকে, আবার কখনও এনে ফেলেছেন ২০০০ দশকে। সেই সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে বর্তমান সময়ের ঘটনাপ্রবাহও।
ঝন্টুদার অতীত দেখানোর সময়ে নজর কাড়লেন খরাজ ও ছোটেবেলার সনাতন (অরণ্য)। রহস্য বোনায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অভিরূপ। দর্শককে একটানা অতীত না দেখিয়ে পরিচালক দ্রুত কাহিনী এগিয়েছেন বর্তমান সময়কে কেন্দ্র করে। কথায় বলে, নিখুঁত অপরাধ বলে কিছু হয় না। এই চিরাচরিত ধারণার মূলে আঘাত করে গল্প বুনেছেন পরিচালক। চরিত্ররা তাদের হাত রাঙিয়েছে রক্তে, কোথাও সামান্য প্রমাণটুকুও না রেখে। মোটর গ্যারেজকে কেন্দ্র করে বাড়তে থাকা অপরাধ তদন্তে শেষমেশ মাঠে নামেন ধুরন্ধর ইন্সপেক্টর প্রিয়নাথ মুখার্জি (কৃষ্ণেন্দু)।
শুধু খরাজ বা কৃষ্ণেন্দুই নন, অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাকি কলাকুশলীদের ভূমিকাও আকর্ষণীয়। সিরিজ়ের নায়ক রুদ্রনীল একই সঙ্গে অপরাধ দলের দলপতি ও একটি পরিবারের মাথাও বটে। দুই স্থানে তাঁর দুই রূপ খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এছাড়াও শিশুশিল্পী অরণ্যর অভিনয়ও মন টানবে দর্শকের।
আরও পড়ুন: ‘ভ্রমরের চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে প্রথমে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম’
রহস্য কাহিনী দেখতে বসলে দর্শক নিজেই গোয়েন্দা হয়ে যেতে চান বেশিরভাগ সময়। এই সিরিজ়ে সেরকম কিছু করতে গেলে নাকাল হতে হবে দর্শকদের। দক্ষ হাতে কাহিনীর প্রতিটা মোচড় সাজিয়েছেন পরিচালক। উত্তেজনার শেষ মূহুর্তে গিয়েও রহস্যের মোড় বারবার ঘুরে যায় অন্য দিকে। সেই সঙ্গে দর্শকদের জন্য রাখা থাকে কিছু সূত্র। সিরিজের শুরুতে হিথ লেজার অভিনীত জোকারের কার্যপদ্ধতি ও কাহিনীর চরিত্রদের মধ্যে বাংলার সেরা পাল্প থ্রিলার লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যও বেশ আকর্ষণীয়।
অপরাধীর মানবিকতার দিকটিও গোটা সিরিজ়ে প্রতীয়মান। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতই অপরাধী তার সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল। তাদের সুরক্ষা নিয়ে সে সর্বদাই চিন্তিত। যথাযথ যত্ন নিয়ে সংলাপ ও ফ্রেম খরচ করে সেটা দেখিয়েছেন পরিচালক।
আরও পড়ুন: ‘ভ্রমরের চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে প্রথমে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম’
রহস্য বুনতে গিয়ে কয়েকটি ছোটখাট ভুলও চোখে পড়ল। ২০০০ সালে কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকান দেখাতে গিয়ে তার তাকে চলে এসেছে একদম হাল আমলে বেরোনো কিছু বই। ২০১৯ ও এ বছর মিলিয়ে প্রকাশিত হওয়া বইয়ের উপস্থিতি দর্শকদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করতেই পারে। সেই সঙ্গে বইয়ের তাকে যে সব প্রকাশনীর নাম চোখে পড়ে, তারাও অনেকেই সেই সময়ে বর্তমান ছিলেন না। এ ছাড়া ওই একই দৃশ্যে অসঙ্গতি রয়েছে সংলাপেও। চরিত্রের মুখ দিয়ে ‘শঙ্কু সমগ্র’ ও ‘ফেলুদা সমগ্র’-এর চাহিদা জানানো হয় যা অবান্তর কারণ তখনও এই দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়নি। এমনকি হাল আমলের আরও একটি বই এই সিরিজ়ে জরুরি ভূমিকা পালন করে।
তবে শুধু অভিনয় বা চিত্রনাট্যই নয়, এই সিরিজ়ের অন্যতম পাওনা অম্লান চক্রবর্তী ও বব সেনের আবহসঙ্গীত। রহস্য কাহিনীর উপযুক্ত করে প্রতিটা পরিস্থিতির জন্য সুর দিয়েছেন তাঁরা। অয়ন শীলের চিত্রগহণ প্রাণবন্ত।
সব মিলিয়ে নিখুঁত অপরাধের একরারনামা তৈরি করে ‘রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ়’-এর দ্বিতীয় সিজ়ন। দর্শকের মাথায় ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্ন: ‘এরপর কী?’