পাল্প নয়, সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘মৃগয়া’: অভিরূপ ঘোষ
প্রথম ছবি ‘K: সিক্রেট আই’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৭ তে। দ্বিতীয় ‘জ়ম্বিস্তান’ ২০১৯ এ। তারপর ওয়েব সিরিজ়েই মাঝের কয়েকটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পরিচালক অভিরূপ ঘোষ (Abhirup Ghosh)। ‘রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ়’, ‘ব্যাধ’, ‘বেঙ্গল স্ক্যাম’, শেষ কয়েক বছরে মূলত সিরিজ়ই পরিচিতি এনে দিয়েছেন তাঁকে। তবে আবারও তিনি বড় পর্দায় ফিরছেন, আর এবার তারকাখচিত ছবি ‘মৃগয়া’ নিয়ে। ছবিতে রয়েছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং প্রিয়াঙ্কা সরকার। মুক্তি মাসখানেক পরেই। সেই ফাঁকে রেডিওবাংলানেট এর সঙ্গে একান্ত আড্ডায় পাওয়া গেল অভিরূপকে
তোমার পরিচালনায় শেষ সিরিজ় ছিল ‘বেঙ্গল স্ক্যাম’, ২০২২ এ। তিনবছর পর আসছে নতুন ছবি। এর বড় বিরতি কেন?
অভিরূপ: বিরতি একেবারেই নয়। বেঙ্গল স্ক্যামের পরে অন্য একটি ছবির কাজ করছিলাম অনেকটা সময় নিয়ে। সেটা যেহেতু শেষ হয়নি তাই অনেকেই জানতে পারেনি। তারপর ‘মৃগয়া’র কাজ তো ছিলই। এর সঙ্গেই হিন্দিতে একটা পাল্প থ্রিলারের কাজ করেছি। ‘রিতা সান্যাল’ নামে সেই থ্রিলার গত বছর হটস্টারে রিলিজ় করেছে। তাই বিরতি নিইনি কোনওভাবেই। ‘মৃগয়া’ যেহেতু বড় প্রজেক্ট তাই একটু সময় লাগলো।
ছবির নাম মৃগয়া কেন? বাঙালির তো মৃগয়া নিয়ে একটা বড়সড় নস্টালজিয়া আছে। যদিও টিজ়ার দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই ছবির সঙ্গে এর কোনও মিল নেই
অভিরূপ: মৃগয়া মানে শিকার। এই গল্পটায় এক অর্থে সেই শিকার ব্যাপারটা থাকছে। মৃণাল সেনের ছবির সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। এই ছবিটা একটা সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরী। কলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া একটা খুনের তদন্তের ওপর বেস করে। মানিকতলা থানার ওসি দেবাশিস দত্ত, তাঁর এলাকায় ঘটে যাওয়া একটা কেস, এবং তার তদন্ত, সেটার ওপরেই এই ছবি। ওঁরই লেখা গল্পটা। একটা ভয়ংকর খুন হয়েছিল। খুনি কাজটা করে কলকাতার বাইরে পালায়। তখন নিজেদের মধ্যে একটা টিম বানিয়ে পুলিশ তাদের পিছু নেয়। সেই দিক থেকে মৃগয়ার চেয়ে ভালো নাম এটার জন্য আর হতে পারত না।
বেশ বড়সড় কাস্ট নিয়ে কাজ করেছ এবার। শুরু থেকেই কি ঠিক করা ছিল কাকে কোন চরিত্রে মানাবে?
অভিরূপ: গল্পটা লেখার সময়েই মাথায় ছিল এই চরিত্রগুলোয় এদের মানাবে। তখনও কিন্তু আমি জানতাম না এদেরকে বললেই পাবো কিনা। কারণ এরা সকলেই এখন খুব ব্যস্ত, প্রত্যেকে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে রয়েছে। তাই চাইলেই যে পাবো এমন ভাবিনি। কিন্তু আমার খুব সৌভাগ্য যে প্রত্যেকের স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়ে যায় আর সকলেই রাজি হয় কাজ করতে।
আরও পড়ুন: রাজ কপূরের বাড়িতে সিমিকে দেখে পছন্দ করেন সত্যজিৎ রায়
প্রথমবার অ্যাকশন চরিত্রে ঋত্বিককে দেখা যেতে চলেছে। কী মনে হয়, দর্শক কীভাবে নেবে?
অভিরূপ: ঋত্বিকদার সঙ্গে বহুদিন থেকেই কাজ করার ইচ্ছে ছিল। যখনই দেখা হতো বলতাম, উনিও আমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলেন। এতদিনে এই স্ক্রিপ্টটা লেখার পর আমার মনে হলো এই চরিত্রে ঋত্বিকদাকে মানাবে। আমি ঠিক এরকম একজনকেই চাইছিলাম এই চরিত্রে। যে একজন পুলিশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব সাধারণ মানুষও। পুলিশ হিসেবে রাফ এন্ড টাফ হলেই যে সে ব্যক্তিগত জীবনেও তাই হবে এমন কিন্তু একেবারেই নয়। আমরা যেরকম পুলিশ কর্মীদের আশেপাশে দেখি তারা ব্যক্তিগত জীবনে খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। যার পরিবার আছে, সে পরিবার জীবনে সুখী। খেতে ভালোবাসে, ফেসবুকে রিল দেখে। মানে আমরা সকলে যেমন এই লোকটাও তেমনই। এখানে ঋত্বিকদার চরিত্রটাও তাই। আর একটা জিনিষও বলার যে ঋত্বিকদাকে যেরকম চরিত্রে দর্শক সবসময় দেখেন এখানে একটু আলাদাভাবে দেখবেন।
বিক্রমের সঙ্গেও এটা তোমার প্রথম কাজ। বিক্রমকে ইদানিং বেশ কিছু অ্যাকশন ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এখানে বিক্রমের চরিত্রটা কেমন?
অভিরূপ: বিক্রমের সঙ্গে আমার যেমন প্রথম কাজ আবার ঋত্বিকদার সঙ্গেও বিক্রম প্রথমবার কাজ করেছে এখানে। বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে কথা হয়েই ছিল যে আমরা একসঙ্গে কাজ করবো। আসলে গল্পটা চারজনকে ভেবে। সেই চারজন হলো ঋত্বিক, অনির্বাণ, বিক্রম এবং রিজ়ওয়ান রব্বানী। রিজ়ওয়ান টেলিভিশনে চেনা মুখ। এখানে এই চারজনের টিম একসঙ্গে তদন্ত করবে।
আরও পড়ুন: বিপ্লবী না ডাকাত? প্রথমবার বায়োপিকে জিৎ
অনির্বাণকে পুলিশের চরিত্রে বহুবার দেখা গেলেও অ্যাকশন চরিত্রে কমই দেখা গিয়েছে
অভিরূপ: অনির্বাণদার রেঞ্জ সাঙ্ঘাতিক। যেহেতু ‘ব্যাধ’ সিরিজে একসঙ্গে কাজ করেছি তাই জানতাম অনির্বাণদাকে এই চরিত্রে মানাবে।
এই চারজন তো পুলিশের চরিত্রে থাকছেন, এছাড়া অভিনেত্রীদের মধ্যে কাকে দেখা যাবে? প্রিয়াঙ্কা আছেন সেটা তো টিজ়ারেই দেখা যাচ্ছে
অভিরূপ: হ্যাঁ প্রিয়াঙ্কা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে রয়েছে। ওর চরিত্রটা সোনাগাছির একজন যৌনকর্মীর। তার একটি ছোট্ট ছেলে আছে। এই ছেলেটি আবার বিক্রমের বন্ধুর মতো। প্রিয়াঙ্কার চরিত্রটা খুন হয়ে যাবে। সেখান থেকেই এই ছবির আসল তদন্ত শুরু হবে। সুস্মিতা চ্যাটার্জী ‘শোর মাচা’ বলে একটা আইটেম নাম্বার আছে, যেটা গতকাল রিলিজ় করেছে ইউটিউবে। এছাড়া অনন্যা ভট্টাচার্য নামে নতুন একটি মেয়ে আছে, এটা ওর প্রথম ছবি।
সৌরভ দাসের সঙ্গে এর আগেও কাজ করেছ। এখানে ওর চরিত্রটা কেমন?
অভিরূপ: সৌরভের চরিত্রটা একটা ট্রাইবাল এলাকায় থাকে। একটু অন্য ধরনের চরিত্র এটা। ওকে দিয়ে আসলে অনেক কিছু করানো যায়। আর যেহেতু এর আগে ওর সঙ্গে কাজ করেছি তাই ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেছে এখন। ওর চরিত্রে এমন কিছু সারপ্রাইজ় এলিমেন্ট আছে যেটা আগে থেকে দেখানো হচ্ছে না, তবে এই ছবিটার পর ওকে নিয়ে কথা হবেই।
আরও পড়ুন: আব্বুলিশ, টেথোস্কোপ আর তিন খুদের স্বপ্ন
এতজন নামি অভিনেতাকে নিয়ে শুট করা, অভিজ্ঞতা নিয়ে কী বলবে?
অভিরূপ: খুবই ভালো অভিজ্ঞতা। যেহেতু এরা সকলেই খুব প্রোফেশনাল তাই অসুবিধা হয়নি কোথাও। শুরুতে কেউই সেরকমভাবে এক অপরকে চিনত না। তারপর একসঙ্গে থাকতে গিয়ে সকলে মজা করে কাজ করেছে। যেহেতু চারজন পুলিশ কর্মী একসঙ্গে কাজ করছে তাই এদের মধ্যে কেমিস্ট্রিটা তৈরি হওয়া জরুরি ছিল। গল্পের প্রথম হাফ কলকাতায়, আর দ্বিতীয় হাফ উত্তরপ্রদেশে দেখানো হবে। এই অংশের শুট হয়েছে কলকাতার আশেপাশেই। কারণ আসল লোকেশনে গিয়ে শুট করার অসুবিধা ছিল।
তোমার সিরিজ বা ছবিতে পাল্প ফিকশনের প্রভাব থাকেই। তুমি নিজেও বলেছ এর আগে। এক্ষেত্রে সেটা কীভাবে থাকছে?
অভিরূপ: হ্যাঁ আমার সব কাজেই মোটামুটি পাল্প ব্যাপারটা থাকে। কিছুদিন আগে হটস্টারের সঙ্গে যে কাজটা করলাম ওটাও পাল্পের ওপর বেস করেই। কিন্তু এই কাজটা খুবই বাস্তববাদী একটা গল্প নিয়ে। যেহেতু এটা সম্প্রতিক অতীতে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা, সেই গল্পে পাল্প ফিকশন ব্যবহার করার জায়গা ছিল না।
আরও পড়ুন: সত্যিই সরে গেলেন নাকি প্রচারের গিমিক? উঠছে প্রশ্ন
এছাড়াও কিছু কম আলোচিত বিষয় নিয়েও তুমি কাজ করে থাকো। যেমন ‘ব্যাধ’ বা ‘ব্রহ্মদৈত্য’। এগুলোকে তোমার সিগনেচার স্টাইল বলা চলে। ‘মৃগয়া’য় সেই ফ্যান্টাসির জায়গাটা নেই। তাহলে তোমার নিজস্ব স্টাইলটা কীভাবে থাকছে?
অভিরূপ: আমার সিগনেচার কোনটা সেটা ভেবে তো আমি কাজ করি না। সেটা দর্শক বুঝবে। আর নিজের পছন্দের ঘরানার ছবি করার ইচ্ছে তো থাকেই। সেটা যে কোনও পরিচালকের স্বপ্নের ছবি। একজন পরিচালক যদি নিজের মনের মতো দশটা ছবি বানাতে চায় তবে সারাজীবনে হয়তো সে পাঁচটা তেমন ছবি বানাতে পারবে। আর সেই ছবিগুলো দেখার দর্শক তৈরি করার জন্যই তাকে অন্য ধরনের ছবিও বানিয়ে যেতে হবে। কারণ একটা ছবি কত মানুষ দেখছেন সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সাফল্য বা হিট যেমন প্রয়োজন তেমনই অন্য ধরনের কিছু কাজ করারও প্রয়োজন আছে। এই মুহূর্তে সব ধরনের কাজই করতে চাই আমি।
তোমার প্রথমদিকের দুটো ছবি অনেকগুলো বছর আগে মুক্তি পেয়েছে। প্রায় ছ’বছর পার করে আবার একটা ছবি আসছে তোমার, পরিচালক হিসেবে কতটা পরিণত হয়েছ বলে মনে হয়?
অভিরূপ: এতগুলো বছর অভিজ্ঞতা তো অনেকটাই হয়েছে। আর কাজ তো করেই এসেছি, সেটা ছবি হোক বা সিরিজ়। আমার আগের ছবিগুলোর বাজেট সেরকম ছিল না। খুবই কম বাজেটে ছবি করেছিলাম সেই সময়। তার মধ্যেও কিন্তু ভালো কাস্ট নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু তখন ছবিগুলোর প্রচার হয়নি একেবারেই। যার ফলে বহু মানুষ জানতেও পারেননি ছবিগুলোর ব্যাপারে। এখন সেটা বুঝি। খানিকটা আইডিয়াও হয়েছে প্রচার কীরকম হওয়া উচিত। তাই এবার চেষ্টা থাকবে মানুষ যাতে ছবিটা সম্পর্কে জানতে পারে।
পরিচালনা করা অভিরূপের পেশা নাকি নেশা?
অভিরূপ: এখন এটাই পেশা আমার। সিনেমা তৈরি ছাড়াও মিউজিক ভিডিও বানাই, বিজ্ঞাপনের কাজ করি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর একসময় চাকরি করেছি, ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করেছি। তবে এই কাজটা বরাবরই করতে চেয়েছি বলে পুরোপুরি টেকনিকাল কাজে চলে আসা।
আরও পড়ুন: কেমন আছে মুকুলের বাড়ি? ছবি তুলে আনলেন রিঙ্গো
সমসাময়িক অন্য পরিচালকদের ছবি দেখো? গত বছর যেসব বাংলা ছবি এসেছে কোনগুলো ভালো লেগেছে?
অভিরূপ: হ্যাঁ অবশ্যই দেখি। গত বছর দুটো ছবি আমার খুব ভালো লেগেছে। একটা হলো ‘বহুরূপী’ আর একটা অঞ্জন দত্তর ছবি ‘চালচিত্র এখন’।
সময়ের সঙ্গে বাংলা ছবি পাল্টাচ্ছে। প্রযোজকরা কতটা পাল্টাচ্ছেন বলে মনে হয়?
অভিরূপ: আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি প্রযোজকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি রিস্ক নিচ্ছে। নতুন প্রযোজকরা ভালো কাজ করতে চাইছে। এমনকি নতুনদের নিয়েও কাজ করার ওপর জোর দিচ্ছে তারা।
হিন্দিতে কাজের সুযোগ পাচ্ছো, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও আসবে। সেক্ষেত্রে বাংলায় কাজ করার আগ্রহ থাকবে কি?
অভিরূপ: বাংলায় সবসময় কাজ করতে চাইবো। হিন্দিতে কাজ করার সুযোগ এলে অবশ্যই করবো, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি একটা অন্য আবেগ রয়েছে। তাই নিজের মনের মতো কাজগুলো বাংলায় করতে বেশি ভালো লাগবে।
