কতটা শার্লক হোমস হয়ে উঠল ‘সরলাক্ষ হোমস’?

ছবি: সরলাক্ষ হোমস

পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল

অভিনয়ে: ঋষভ বসু, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, গৌরব চক্রবর্তী, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, রাজনন্দিনী পাল, শতাফ ফিগার, কাঞ্চন মল্লিক, প্রিয়া কার্ফা

দৈর্ঘ্য: ২ঘণ্টা ১৩ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ কথাটার মধ্যে একটা আদ্যন্ত সাহেবিয়ানা আছে। সে খাবার আপনি লন্ডনে বসেই খান কি লেক টাউনে, মেজাজটা প্রায় একইরকম থাকে। কারণ সেই স্বাদের সঙ্গে ব্রিটিশ আভিজাত্য জড়িয়ে থাকে। সায়ন্তনের সাম্প্রতিক ছবি ‘সরলাক্ষ হোমস’ (Saralakkha Holmes) একেবারেই ওই ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ধরনের। যতই চরিত্রের নাম পাল্টে যাক, প্রেক্ষাপট কিন্তু মূল গল্পেরই। কাজেই এ এক অন্য রহস্য কাহিনী বলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জায়গা বিশেষ থাকে না। শুধু নির্মাণের স্বাধীনতা রক্ষার আড়ালটুকু থেকে যায়।




আর্থার কোনান ডয়েলের গল্প অবলম্বনে হলেও চরিত্রের নামের জন্য পরিচালককে রাজশেখর বসুর শরণাপন্ন হতে হয়েছে, কারণ গোয়েন্দা চরিত্রটি এখানে বাঙালি। ‘সরলাক্ষ হোম’ নামটির কারণে শুরুতেই লেখকের নাম করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে যা সত্যিই জরুরি ছিল। শার্লক যেমন সরলাক্ষ (ঋষভ), ওয়াটসন তেমনই এখানে আর্য সেন (অর্ণ)। আর স্যার হেনরি হলেন শেখর রায়চৌধুরী (গৌরব), অর্থাৎ রায়চৌধুরী বংশের শেষ কুলপ্রদীপ।

আরও পড়ুন: শার্লক হোমসকে বাঙালি প্রেক্ষাপটে এনে ফেলতে চাইনি: সায়ন্তন

রায়চৌধুরী বংশের প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু, সদ্য লন্ডনের অদূরে বংশের পুরোনো বাড়ি বা প্রাসাদ পরিদর্শনে গিয়ে নিহত হয়েছেন তার কাকা। এই মৃত্যু আবারও উসকে দিয়ে গিয়েছে বংশের ওপর লেগে থাকা সেই শতাব্দী প্রাচীন অভিশাপকেও। তাই উপায় না দেখে হার্টের অসুখ নিয়েও ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে লন্ডনে এসে সরলাক্ষর সঙ্গে দেখা করেন শেখর। এরপরের গল্প ডার্টমুরের জঙ্গল ও প্রাসাদ ঘিরে। মূল গল্পের সব চরিত্রই সামান্য ওলটপালট করে স্বমহিমায় বিরাজ করছে এই ব্রিটেনস্থিত বাঙালি গল্পে। আসা যাক নির্মাণ প্রসঙ্গে।

দশ মিনিটের একটি ছোট্ট পূর্বকথার মাধ্যমে কলকাতার সরলাক্ষের লন্ডনে গিয়ে শার্লক হয়ে ওঠাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা হয়েছে, যা ঠিক ধোপে টেকে না। রাতারাতি সৎ দাদা মাইক্রফ্টের কাছে সরলাক্ষকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত তার বাবা বাঙালি খ্রিস্টান মিস্টার হোমস (বাদশা মৈত্র) নিতেই পারেন কিন্তু ভিসা জোগাড় করা অবধি সময়টুকু মন্ত্রীদাদাটি (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) দিলেন কী করে বোঝা যায় না। আর মাত্র কয়েকদিনে সরলাক্ষ কীভাবেই বা খোদ হোমসের দেশে গিয়ে বিখ্যাত হয়ে একেবারে ডাকনামে শার্লক হয়ে উঠলেন কিছুই পরিষ্কার নয়। ছবির সবচেয়ে নড়বড়ে জায়গা এটাই। চরিত্রকে গড়ে তোলার ভিত মজবুত না হলে তারপর গল্পকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা কঠিন হয়। চিত্রনাট্য রচনায় সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও পদ্মনাভ দাশগুপ্ত আর একটু যত্নবান হতে পারতেন। তবে গল্পের প্রেক্ষাপট এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দুই ক্ষেত্রেই সফল সায়ন্তন। নাটকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে রহস্যকে গুছিয়ে বুনেছেন তিনি। ছবির শুরু থেকে শেষ বিনোদনের অভাব হবে না, তবে শেষের দিকে দশ মিনিট কম করা যেতে পারত। দেবজ্যোতি মিশ্রর সুরে ঊষা উত্থুপ ও রূপম ইসলামের গাওয়া গানদুটি শুনতে দুর্দান্ত লাগে। আগাগোড়া রীতিমত স্মার্ট এবং ঝকঝকে কাহিনী সূত্রের জন্য টুবানের চিত্রগ্রহণ অবশ্যই অনেকটা দায়ী। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে ছবি কিছুটা দীর্ঘ লাগবে। ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলি বেশ রিয়ালিস্টিক হলেও শেষের সংঘাতকে এত বড় করে না দেখালেও চলতো কারণ মূল আতঙ্কের কারণের এক গুলিতেই খতম হওয়ার কথা। সেটা না হয়ে পরবর্তী সময়টুকু জোর করে গল্প টেনে নিয়ে যাওয়া হলো কেন বোঝা যায় না। আর অবশ্যই সদ্য প্রায় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কীভাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে মারকাটারি অ্যাকশন করেন সেটাও বোধগম্য হয় না। ফ্যান্টাসি নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু গোয়েন্দা গল্পে সেটা রাখার আগে একটু ভাবার দরকার ছিল। 

আরও পড়ুন: রসায়ন নয়, না-পাওয়াই পাওয়া ‘ধূমকেতু’তে

বইয়ের বাইরে বর্তমান প্রজন্মের কাছে হোমস মানে মূলত বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ এবং রবার্ট ডাউনি জুনিয়র অভিনীত শালর্ক হোমসের টেলিভিশন সিরিজ় ও ছবি। সেই সমস্ত অভিনেতাদের সঙ্গে তুলনায় না গিয়েও যদি শুধু গল্প ধরে এগোনো যায় তাহলেও ছটফটে, অস্থিরমতি, প্রবল বুদ্ধিমান এবং আনপ্রেডিক্টেবল (এর সঠিক বাংলা করে হোমস চরিত্রকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব) শার্লককে কিছু ক্ষেত্রে ভালই অনুসরণ করেছেন ঋষভ। তবে তদন্তের সময় ছাড়া ভাবনায় ডুবে গেলে সে একজন সিরিয়াস মানুষও বটে। এই জায়গায় বাংলার হোমস সেই চড়াদাগের অভিনয়েই থেকে গেলেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে সরলাক্ষ চরিত্রের রূপরেখা আলাদা হতেই পারে। মলাট চরিত্রে ঋষভ খেটেছেন বোঝা যায়, ভয়েস টোন এবং শারীরিক গঠনের কারণে সেই খাটনি হয়তো দ্বিগুণ হয়েছে। তবে প্রথম প্রকাশ হিসেবে মন্দ নয় তাঁর প্রচেষ্টা। নিজেকে কিছুটা নামিয়ে নিয়ে আগাগোড়া নিচু তারে প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন অর্ণ। চঞ্চলের ভূমিকায় নিজের ঝকঝকে চেহারা এবং চোখের সদ্ব্যবহার করেছেন সাহেব। ইদানিং বেশ অন্যরকম চরিত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁকে এবং সেই সব জায়গায় দিব্যি মানিয়েও যাচ্ছেন তিনি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের উত্তরাধিকারী শেখরের ভূমিকায় গৌরব যেমন মানানসই তেমনই সুপুরুষ দেখতে লাগে তাঁকে। ছোট চরিত্রে ভালো লাগে রাজনন্দিনীকেও। অনেকদিন বাদে পর্দায় দেখা গেল প্রিয়া কার্ফাকে। রহমানের চরিত্রে কাঞ্চনের প্রায় কিছুই করার ছিল না। সিরিয়াস চরিত্রে শতাফ মানানসই।

আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার

বাংলায় এর আগে ভুরি ভুরি গোয়েন্দা ছবি হলেও একেবারে খোদ হোমসকে নিয়ে ছবি করার সাহস বা ভাবনা আর কারওর মধ্যেই দেখা যায়নি। সেই দিক থেকে অবশ্যই অনেকটা ঝুঁকি নিয়েছেন সায়ন্তন ও ঋষভ দুজনেই। কারণ গোয়েন্দা কাহিনীপ্রেমী বাঙালি অল্পেতে খুশি তো হয়ই না, আবার হোমসের মতো আইকনিক চরিত্র হলে প্রত্যাশাও থাকে আকাশছোঁয়া। আর সরলাক্ষের নামের আড়াল থাকলেও গল্প তো আসলে শার্লকেরই। তবু প্রথম আবির্ভাব হিসেবে সামান্য ভুলত্রুটি থাকলেও একেবারে ছাপোষা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বসে ইংলিশ ব্রেকফাস্টের স্বাদ নেওয়ার জন্য দর্শকের একবার অন্তত হলে যাওয়া অবশ্য প্রয়োজন।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *