‘আগে শুধু অভিনয়টা মন দিয়ে করলেই চলতো’

বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের কোনও ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। মমতা শংকর তেমনই একজন। একাধারে অভিনেত্রী ও অভিজ্ঞ এই নৃত্যশিল্পী স্বভাবের দিক থেকে এখনও এতটাই মাটির কাছাকাছি, যেন চাইলেই তাঁকে ছোঁয়া যায়। সেরকমই একদিন কাজের ফাঁকে তিনি সময় বার করলেন আমাদের জন্য। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে আড্ডা জুড়লেন ‘গৃহযুদ্ধ’র নিরুপমা।

কেমন আছো? কি করছ এবার পুজোয়?

এই তো ভালোই আছি। পুজোয় সত্যিই কিচ্ছু করছি না। বাড়িতেই আছি। আগে পুজো পরিক্রমায় গেছি কোনও কোনওবার, কিন্তু এবারে আর না। বাড়িতেই মায়ের সঙ্গে সময় কাটাব। আর এখন আমার বাড়িতে এক ছোট্ট অতিথিও এসেছে, এই দুজনকে নিয়েই কেটে যাবে পুজোটা।

তোমার ছবির কথায় আসি। তোমাকে অনেক নতুন পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়। অরিন্দম ভট্টাচার্যর সঙ্গে ‘অন্তর্লীন’ করেছ, ক’দিন আগে জিত চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘শেষের গল্প’ করলে, আর এখন তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ‘ভটভটি’তে কাজ করছ। নতুনদের সঙ্গে এত কাজ করো কেন?

আমার ভালো লাগে নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে। আজকে যারা বিখ্যাত পরিচালক, তাঁদের অনেকেরই প্রথম ছবিতে আমি কাজ করেছি। যেমন গৌতম ঘোষ বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এরকম আরও অনেকে আছে। আমার মনে হয় প্রত্যেকেই তো একদিন নতুন থাকে, তাই তাদের সেই সুযোগটা দেয়া উচিত।

তোমার কাছে যখন নতুন ছবির চিত্রনাট্য আসে, কি দেখে ঠিক করো যে কোন ছবি করবে আর কোনটা করবে না?

করব না তখনই বলি যদি কথা বলে মনে হয় আমার সঙ্গে ঠিক মিলবে না। কথা বললে অনেকটাই বোঝা যায় যে উল্টোদিকের মানুষটা কিভাবে ভাবছেন। সেটা যদি ঠিকঠাক মনে হয় তাহলে কথা এগোনো যায়। এছাড়া চরিত্রটায় কিছু করার আছে কিনা সেটা তো অবশ্যই দেখতে হয়।

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ছবিটা দেখার পর থেকেই মনে হয়েছিল, আজ জিজ্ঞাসা করছি, ‘পিঙ্ক’-এর ওই চরিত্রটা তুমি কি দেখে করেছিলে? খুব কিছু জরুরী চরিত্র তো ছিল না ওটা

ওটা পুরোপুরি সম্পর্কের খাতিরে করা জানো। অনিরুদ্ধ (রায়চৌধুরী) এত করে বললো যে আমি না করতে পারিনি। আর আমাকে যেভাবে রোলটা বোঝানো হয়েছিল পরে করতে গিয়ে দেখলাম সেখানে কিছুই করার নেই। ছোট রোলে আমি অনেক অভিনয় করেছি। কিছুদিন আগেই অরিন্দমের ‘ফ্ল্যাট নাম্বার ৬০৯’-এ ছোট্ট একটা চরিত্র করেছিলাম। আবার ‘মাছের ঝোল’-এও আমার চরিত্রটা ছিল একজন অসুস্থ মানুষের। কিন্তু সেখানে আমার ভূমিকাটা খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু ‘পিঙ্ক’-এ আমার চরিত্রটায় কিছু করার ছিল না। জয়াদির (বচ্চন) সঙ্গে পরে দেখা হওয়াতে খুব বকেছিলেন, ‘এই চরিত্রটা কেন করেছ, সারাক্ষণ শুইয়ে রেখেছে তোমাকে! আমি খুব রাগ করেছি।’ আমারও মনে হয়েছিল চরিত্রটায় আর একটু গল্প থাকতেই পারত। তবে ওই, অনিরুদ্ধকে স্নেহ করি বলেই করেছিলাম তখন।

আচ্ছা ধরো, কোনও চরিত্রে কাজ করার পরে সেটা যদি ঠিকঠাক না হয়, বা হয়তো ছবিতে সেটাকে সেইভাবে রাখাই হলো না, কেমন লাগে? দর্শক কি ভাববেন সেটা মনে হয় কি?

খুব খারাপ লাগে। কিছু জায়গায় না করা যায় না, অথচ কাজটা হয়তো মনের মতো হচ্ছে না। তখন খুব কষ্ট হয়, জিনিসটা ভেতরে কোথাও কুরে কুরে খায়। দর্শক কিভাবে নেবেন সেটা নিয়ে আর এই পর্যায়ে এসে ভাবি না। কিন্তু নিজের জন্যই খারাপ লাগে। আমি তো খুব বেশি কাজ করি না, তাই মনে হয় যেটুকু করব সেটা যেন ভালো হয়। এখন কেউ অন্যরকম চরিত্র দিলে ভাল লাগে করতে, যেমন ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ বা ‘অন্তর্লীন’-এ করলাম। এই ধরণের কাজ আরও বেশি করে করতে চাই। চরিত্র ছোট হলে আপত্তি নেই, কিন্তু ছবিতে সেই চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা যেন থাকে।

মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার পরে এই নতুন পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে কিরকম লাগে তোমার? মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না?

না সেভাবে কোনও অসুবিধা হয়নি কখনও, কেন না প্রত্যেকের কাজ করার ধরণ আলাদা। পরিচালক যেভাবে চান আমি সেইভাবেই কাজ করি। কিন্তু অসুবিধা হয় এই ফিল্মের প্রমোশন বা ট্রেলার লঞ্চের মতো অনুষ্ঠানগুলোয়। এসব আগে হতো না। এখন এত বেশি হয় এগুলো, এত জায়গায় যেতে হয়, এগুলো সত্যি ভালো লাগে না। আগে শুধু অভিনয়টা মন দিয়ে করলেই চলতো, এখন আরও অনেক কিছু করতে হয়।

আগেকার ছবির অনেক গল্প আমরা শুনেছি যে তখন ছবি করতে করতে শ্যুটিং ইউনিট একটা পরিবারের মতো হয়ে যেত। এখন ছবি করতে গিয়ে কি সেই পরিবেশটা পাও?

এখন সবাই খুব প্রফেশনাল এটা ঠিক। তবে আমার সৌভাগ্য যে আমি বরাবর এটা পেয়ে এসেছি। কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি। সিরিয়াল হলে যেমন একটা সিন শেষ করে শাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতেই পরের সিনের ডায়লগ মুখস্থ করতে হয়, সময় প্রায় থাকেই না, সিনেমাতে তো তেমন নয়। অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে কিছুদিন ধরে কাজ করেন, সেখানে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে ওঠাটা দরকার। আমি সেটা প্রতিবারেই পেয়ে যাই, তাই অসুবিধা হয়নি কখনও। আমি যেহেতু অনেক ছবি একসঙ্গে করি না, তাই বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে অ্যাডজাস্ট করার ব্যাপার থাকে না। আর একটা ব্যাপার হলো আজকাল ছবির শ্যুটিং খুব তাড়াতাড়ি হয়। আগে অনেক সময় নিয়ে একটা ছবি তৈরি হতো। ফলে কন্টিনিউইটি ধরে রাখার একটা ব্যাপার থাকতো। এখন সেসব হয় না। একটানা শ্যুটিং করে কাজ শেষ করে দেওয়া হয়। আমি নিজে কোনওকালেই একসঙ্গে অনেক কাজ করিনি, বেছেই ছবি করতাম। তাই আমার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু অনেককেই দেখতাম একইসঙ্গে তিন চারটে ছবির কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

পুজো নিয়ে একটা একেবারে অন্য প্রসঙ্গে যাই। একদিকে নারীশক্তির আরাধনায় মেতে রয়েছে গোটা দেশ, আবার রোজ খবরের কাগজ খুললেই সেই নারীর লাঞ্ছনার কথা খবরে উঠে আসছে রোজ। এই বৈপরীত্য তোমাকে ভাবায়?

দেখো আমি যেটা বলবো সেটা কিন্তু সকলের পছন্দ হবে না। আমার মতে নারী যদি চায় এটাকে অনেকটাই রুখতে পারে। আমরা মেয়েরাই মেয়েদের সবথেকে বড় শত্রু।

বেশ, বুঝলাম। কিন্তু যখন কোনও দুধের শিশু বা বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার ওপর নির্যাতন হয়, তাকে তুমি কী বলবে?

দেখো, কিছু বিকৃত রুচির মানুষ চিরকালই ছিল। যুগ যুগ ধরেই ছিল, এখন আরও বেড়েছে। কিন্তু কেন বেড়েছে তার কারণটা খুঁজে বার করতে হবে না? আজকাল ওয়েব সিরিজ়গুলো সেন্সর করা হয় না, সেগুলো সবাই ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছে, এবং তা সমাজের সব স্তরের মানুষ দেখছে। তার মধ্যে কিছু মানুষের রুচি বিকৃত হবেই। বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজ়, আর কিছু বিজ্ঞাপন এমনভাবে দেখানো হয় যেখানে ইচ্ছে করে এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। মেয়েরাই তো সেগুলোতে অভিনয় করছে। এবার একটা অশিক্ষিত, নোংরা রুচির মানুষ যখন ওটা দেখছে সে তো ওই জায়গায় নিজেকে কল্পনা করছে। তারপর সেই ইচ্ছেটা পূরণ করার জায়গা না পেয়ে হয়তো গ্রামের একটি নিরিহ বাচ্চা মেয়ের ওপরে সেটা ফলাচ্ছে। ছবিতে বা ওয়েব সিরিজ়ে অনেক সময়েই গল্পের প্রয়োজনও থাকে না এমন সব দৃশ্য দেখানোর। জন্মনিরোধকের বিজ্ঞাপনে কখনওই তার কার্যকরী দিক বা সংক্রমণ বা এইচআইভি নিয়ে বলা হয় না। এমনভাবে দেখানো হয় সেটা সকলের সঙ্গে বসে দেখা যায় না। একটা ধর্ষণের দৃশ্য এমনভাবে দেখানো হবে কেন যেখানে নারীর শরীরটাই মূল? সেটা অন্যভাবে দেখানো যাবে না কেন? আগেকার ছবিতে দেখানো হতো না? এখন কিছু বললেই একটাই উত্তর, ‘বেশ করেছি।’ আমার কথা হচ্ছে, আমি যদি জানি ওই রাস্তায় পাগলা কুকুর আছে, আমি কি সেখান দিয়ে যাব? আমার দামী জিনিস কি আমি বাড়িতে খোলা ফেলে রাখি না কি আলমারিতে তুলে রাখি? কেন রাখি? নিরাপত্তার কারণেই তো। তাহলে এক্ষেত্রে সাবধান হতে বললেই ‘বেশ করেছি’র প্রসঙ্গ আসে কেন? আমার ব্যাপারে আমি সাবধান না হলে অন্য কারোর দায় কেন থাকবে? নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি আমি রাস্তার মানুষকে দেব? আসলে এই কথাগুলো শুনলেই আমার এত রাগ হয়, কেন মেয়েরা একটু সাবধান হবে না, কেন নিজেদের ব্যাপারে যত্নশীল হবে না? এটা আমার মতামত, অন্য কারোর সঙ্গে নাও মিলতে পারে। কেউ হয়তো বিপদ আসতে পারে জেনেও বেপরোয়া হতে পারে, তবে আমি মনে করি বিপদ বুঝে আগে থেকে সাবধান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

ছবি: রাজীব মুখোপাধ্যায়

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *