ঐতিহ্যের পুজো: ছাতুবাবু-লাটুবাবু
উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িগুলির পুজোর মধ্যে প্রায় সবকটিই যথেষ্ঠ প্রাচীন ও ঐশ্বর্যশালী। বৈভব ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে রীতিমতো একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে এরা। সে সুদিন গেছে, প্রায় সকলেরই সেই প্রাচুর্যের সূর্যও আজ অস্তমিত। কিন্তু তবু বনেদিয়ানা আর আন্তরিকতার মেলবন্ধনে সমস্ত রীতিনীতি মেনে আজও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে পুজোগুলি। তেমনই একটি পুজো ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পুজো। ২৪৭ বছরের পুরনো এই পুজোটি আজও তার ঐতিহ্যের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে।
সে সময় ব্রিটিশরা একটু একটু করে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। বাংলার ব্যবসায়ীদের মধ্যে রামদুলাল দেব (সরকার) তখন বেশ পরিচিত নাম। তবে রামদুলাল ব্রিটিশদের সঙ্গে নয়, বরং মার্কিনিদের সঙ্গে ব্যবসা করেই যশোলাভ করেছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতালাভের পর এই ব্যবসা শুরু হয়। এখান থেকে মূলতঃ মশলা ও মসলিন রফতানির ব্যবসা ছিল রামদুলালের। বদলে আমেরিকা থেকে আসতো নানান পণ্য। সেই আমলে নাকি জর্জ ওয়াশিংটনও রামদুলাল দেবকে এই রফতানি সূত্রে যথেষ্ঠ সমীহ করতেন। ফলে রামদুলালের কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠেছিল অচিরেই। বলা হয়, রামদুলাল দেব ছিলেন বাংলার প্রথম কোটিপতি। এই রামদুলাল দুর্গাপুজোর প্রচলন করলেন ১৭৭০ সালে, তাঁর বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে। তিনি প্রয়াত হবার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পুজোর দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর দুই পুত্র আশুতোষ নাথ দেব বা ছাতুবাবু, ও প্রমথনাথ দেব বা লাটুবাবুর ওপর। কলকাতার বাবু কালচারের দুই দিকপাল ছিলেন এই দুই ভাই। বুলবুলির লড়াই ও নানান অদ্ভুত শখের জন্য কলকাতার বাবু সমাজে এঁরা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের সময়েই এই বাড়ির দুর্গাপুজো খ্যাতি লাভ করে। এঁদের নামে পুজোর নাম হয়ে যায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পুজো।
এখানে মা দুর্গাকে দশমহাবিদ্যা রূপে পুজো করা হয়। প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু হয়, যা চলে দশ দিন ধরে। ষষ্ঠী পর্যন্ত শালগ্রাম শিলার পুজো করা হয়। এখানে শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব তিনটি মতের মিলনে দেবীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। বৃহৎ নান্দীকেশ্বর পুরাণ মেনে পুজো হয়ে আসছে বরাবর। সাবেকি একচালার ঠাকুর হয়। তবে চিরাচরিত পারিবারিক মায়ের রূপটি এখানে একটু অন্যরকম। এখানে প্রতিমার ডানদিকে মহাদেব ও বামে শ্রী রামচন্দ্র বিরাজ করেন। দুর্গার দুই সখী জয়া ও বিজয়া থাকে দুইপাশে। ১০৮ টি রুপোর প্রদীপ জ্বেলে সন্ধিপুজো হয়।
অষ্টমীতে কুমারী পুজোর প্রচলন আছে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়িতে। অষ্টমী পুজোর পরে বাড়ির মহিলারা সিঁদুর খেলেন। এটাই এ বাড়ীর রেওয়াজ। এই বাড়িতে আজও পুজোর পোশাক শুধুই শাড়ি ও ধুতি। এছাড়া অন্য পোশাক পরেন না পরিবারের লোকেরা। এখানে বলির প্রচলন আছে। তবে স্বাভাবিক কারণেই পশুবলি হয় না। তার বদলে চালকুমড়ো ও আখ বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীতে এখানে মহাভোজের ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয় পরিজন মিলিয়ে প্রচুর মানুষ নিমন্ত্রিত হন। এইদিন লুচি তরকারি ছাড়াও লেডিকেনি ও দরবেশ ভোগ দেওয়া হয় মা দুর্গাকে। এছাড়া অন্যদিন পঞ্চদেবতা, নবগ্রহ, ৬৪ দেবদেবী ও মা দুর্গাকে নিয়ে মোট ৭৯টি নৈবেদ্য প্রস্তুত করা হয়। অন্নভোগও দেওয়া হয়ে থাকে। পুজো উপলক্ষে প্রায় প্রতিদিনই পারিবারিক মিলনসন্ধ্যা ও নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
দশমীতে প্রথমে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর মা দুর্গার পুজো করা হয় অপরাজিতা রূপে। আগে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে কৈলাশে মহাদেবকে খবর পাঠানোর রীতি থাকলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ফলে সে নিয়ম আর মানা হয় না। তাই বর্তমানে সাদা পায়রার গলায় নীল রঙ করে তাকে ওড়ানো হয়। প্রতিমা বিসর্জনের আগে কনকাঞ্জলি দেবার প্রথা রয়েছে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পুজোয়।