শার্লক হোমসকে বাঙালি প্রেক্ষাপটে এনে ফেলতে চাইনি: সায়ন্তন

বাংলায় সরাসরি শার্লক হোমসকে নিয়ে ছবি এর আগে হয়নি। ‘সরলাক্ষ হোমস’ (Saralakkha Holmes) ছবির ক্ষেত্রে নামের আড়াল রেখেছেন নির্মাতারা, তবে এখানে গল্পের প্রেক্ষাপট লন্ডন। তাই এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট করে হোমসের কাহিনী এর আগে কেউ তুলে ধরেননি এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে গোয়েন্দা শ্রেষ্ঠ হোমসকে নিয়ে এত ছবি, টেলিভিশন সিরিজ় এবং ওয়েব সিরিজ় হয়েছে যে সেই কাহিনীকে বাংলায় তুলে ধরা অবশ্যই বেশ দুঃসাহসী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপ নিয়েছেন পরিচালক সায়ন্তন ঘোষাল (Sayantan Ghosal)। আগামী ছবি ‘সরলাক্ষ হোম’ নিয়ে রেডিওবাংলানেট এর নানান প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।




প্রশ্ন: শার্লক হোমসকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হলো কেন? তোমার এই সময়ের ছবিগুলো সবই হয় মৌলিক গল্প নয়তো বাংলা সাহিত্যের গল্প অবলম্বনে। হঠাৎ কন্যান ডয়েল কেন?

সায়ন্তন: সাহিত্য নিয়ে কাজ করা তো নতুন নয়। এর আগে ‘যকের ধন’ করেছি, ব্যোমকেশ করেছি, টেনিদাও করেছি। আগেও সাহিত্য অবলম্বনে কাজ করেছি আবারও করব। আসলে প্রত্যেক পরিচালকের তো কিছু স্বপ্ন থাকে যে এই চরিত্রটা নিয়ে বা এই গল্পটা নিয়ে একটা ছবি করব, সেইরকমই শার্লক হোমসকে নিয়ে বা আর একটু ভালো করে বললে ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে বহুদিন ধরেই ছিল। এই গল্পটা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর কাজ হয়েছে, বাংলাতেও যথেষ্ট সফল কাজ হয়েছে। তবে আমার মূল গল্প থেকে খুব একটা সরে আসার ইচ্ছে ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ব্রিটিশ গোয়েন্দাকে সেইভাবেই রাখতে, শুধু ‘সরলাক্ষ হোম’ নামটাই ঠিক আছে। এর বাইরে খুব কিছু পাল্টে ফেলার ইচ্ছা আমার ছিল না।

প্রশ্ন: অর্থাৎ শার্লক থেকে সরলাক্ষ, এবং সেই চরিত্রে ঋষভ বসু। এর আগে এরকম কোনও চরিত্রে দর্শক ঋষভকে দেখেনি। তাহলে এরকম আইকনিক চরিত্রে নতুন কারোর ওপর ভরসা করলে কীভাবে?

আরও পড়ুন: চারদিনে ₹১০ কোটি ছাড়াল ‘ধূমকেতু’, দাবি নির্মাতাদের

সায়ন্তন: যখন থেকে এটা নিয়ে ছবি করব ভেবেছি তখন থেকেই একটা ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম যে এমন কোন অভিনেতাকে এই চরিত্রে কাস্ট করবো না যার এই ধরনের কোনওরকম চরিত্রে অভিনয়ের ব্যাগেজ আছে। বাংলা ছবিতে তো এমন কয়েকজন অভিনেতা আছেনই যে মুখগুলো বারবার ফিরে আসে গোয়েন্দা বা এডভেঞ্চার চরিত্রে। সে ফেলুদা ব্যোমকেশ বা অন্য যে কোনও জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র হোক কয়েকটা মুখ আমরা বারবার দেখতে পাই। আমি একেবারে ফ্রেশ একটা মুখ চেয়েছিলাম শার্লকের চরিত্রে। তবে এটাও ঠিক যে এর আগে ঋষভের কোনও কাজ আমি দেখিনি। যদিও ওর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয় আমি বলেছিলাম আমি তোমার কাজ দেখেছি এবং আমার ভালো লেগেছে, তবে সেটা সত্যি ছিল না। ওর চেহারাটা চেনা থাকলেও ওর কাজের টিজার ট্রেলার ছাড়া আর কিছু তার আগে আমি দেখিনি। তবে ওর চেহারায় একটা শার্পনেস আছে যেটা এই চরিত্রের জন্য বেশ মানানসই বলে আমার মনে হয়েছে।

প্রশ্ন: সেই ভরসা কতটা ঠিক ছিল বলে এখন মনে হয়? কাজ করার পর কী বলবে?

সায়ন্তন: এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার বলা যায়। ঋষভকে আমরা প্রযোজকের অফিসে ডেকেছিলাম ছবিটা নিয়ে কথা বলতে। সেখানে আমি আর হিমাংশু (ধানুকা) দুজনেই ছিলাম। ওর তখনও অবধি কোনও ধারণা ছিল না ওকে কোন চরিত্রের বা কোন ছবির জন্য ডাকা হয়েছে। ওকে যখন বলা হল যে এই চরিত্রে আমরা তোমাকে ভাবছি ও সবটা শুনে খুব একটা রিএক্ট করেনি। তবে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমাকে একটা মেসেজে লিখেছিল যে ‘আমার থেকে ভালো শার্লক তুমি এই বাংলায় আর পাবে না’। ওর এই কনফিডেন্সটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। তারপরে কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি যে শার্লক হোমস নিয়ে ওর প্রচুর পড়াশোনা এবং রিসার্চ রয়েছে। ও নিজে এই চরিত্র করবে এমন হয়তো কখনও ভাবেনি তবে এটা এমনিতেই ওর প্রিয় চরিত্র হওয়ায় আগে থেকেই অনেকটা প্রস্তুতি ওর ভেতরে ছিল। সেটা আমার জন্যেও খুব সুবিধা হয়েছিল। এছাড়া ওর চেহারাও অনেকটাই এই চরিত্রে মানিয়ে যায়, তার কারণ একেবারে বাঙালি চেহারা বলতে যেটা বোঝায় সেটা কিন্তু ওর নেই।

প্রশ্ন: শার্লক হোমসের চরিত্রে আমাদের সামনে এত বড় বড় উদাহরণ রয়েছে, এমন এমন অভিনেতাকে এই চরিত্রে দেখা গিয়েছে যে তুলনা আসবেই সেটা যে ভাষাতেই হোক না কেন। এছাড়া বাঙালি দর্শক আজকাল যে কোন ছবি নিয়েই ট্রোল করতে ভালোবাসে। আর চরিত্র যেখানে হোমসের সেখানে ঝুঁকিটা তো রয়েছেই, সেটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছো কি?

সায়ন্তন: এগুলো নিয়ে এখন আর খুব একটা ভাবি না। আগে সত্যিই খারাপ লাগত, যে এত পরিশ্রম করে সময় দিয়ে খেটে কাজটা করার পর কিছু সংখ্যক লোক সেটা নিয়ে ট্রোল করছে। এখন আর এগুলো নিয়ে কিছু মনেই হয় না। বলা যায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং একটা ছবি করার পর সেটা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা না হলেই আজকাল অস্বস্তি লাগে, কারণ ট্রোল হচ্ছে বা চর্চা হচ্ছে মানে তো লোকে সেটা দেখছেও। কেউ কিছু বলছে না মানে তো পাত্তা দিচ্ছে না। না দেখলে তো আর ট্রোল করা যায় না। তাই এই ব্যাপারটা এখন আর ততটা খারাপ লাগে না।

প্রশ্ন: অর্ণকে (মুখোপাধ্যায়) ওয়াটসন চরিত্রে নেওয়ার পিছনে কারণ কী ছিল?

সায়ন্তন: অর্ণর সঙ্গে কাজ করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার অনেকদিন ধরেই। ওর অনেক কাজ দেখেছি আমি। ওর ছবি, নাটক সব কিছু দেখেই আমার খুব ইচ্ছা ছিল ওকে নিয়ে কাজ করার। তো এরকম একটা কাজ করবো বলে যখন ভাবলাম ওকে বলতে ও রাজিও হয়ে গেল। আর আমার প্রযোজকদের ধন্যবাদ যে এরকম বড় বাজেটের এবং অনেকটা ঝুঁকির কাজ একেবারে নতুন একটা জুটি নিয়ে করার ব্যাপারে তারা আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। বিদেশে শুট মানে তো অনেকটাই বড় বাজেটের ব্যাপার। এই ধরনের চরিত্র দুজনেই এর আগে যেহেতু করেনি সেদিক দিয়ে দর্শকদের ওপর একটা নতুন ইম্প্যাক্টও আসবে বলে মনে হয়েছে আমার।

প্রশ্ন: এই গল্পটা নিয়ে বাংলা এবং হিন্দিতে দুটো মনে রাখার মতো ছবি হয়েছে। একটা ‘জিঘাংসা’ আর একটা ‘বিস সাল বাদ’। দুটো ছবিই দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তারপরেও একই গল্প নিয়ে কাজ করলে কেন? হোমসের তো আরও অনেক গল্প ছিল

আরও পড়ুন: বিশ্বজিতের ছবিতে নেতাজি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি

সায়ন্তন: এই গল্পটা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার শুরু থেকেই ছিল, তাছাড়া গল্পে কিছু নিজস্ব টাচ আমি রেখেছি। এমন বলবো না যে গল্প অনেকটাই পাল্টে গেছে বা সেখানে খুব বেশি কিছু বদল এসেছে তবে কিছু নতুন সারপ্রাইজ তো গল্পে থাকবেই। সেটা এর আগে কোনও ছবিতে ছিল না। আর বাংলা বা হিন্দিতে যে ছবিগুলো এর আগে হয়েছে সেগুলো ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ছবিটাকে ফেলে করা হয়েছিল। আমার গল্পে সেটা হচ্ছে না। বরং যে এখানে শার্লকের ভূমিকা নিচ্ছে বা তার এই সরলাক্ষ হয়ে ওঠার একটা ব্যাক স্টোরি থাকছে এবং ছবিটা দর্শকের ভালো লাগলে এটাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার আছে।

প্রশ্ন: অর্থাৎ হোমসের গল্পকে বঙ্গীকরণ না করে শুধু ভাষাটা পরিবর্তন করে বাংলায় দেখতে চলেছি আমরা। সেটা তো বেশ কঠিন একটা কাজ, এছাড়া বাঙালি এইসব চরিত্র নিয়ে খুব স্পর্শকাতরও। চেনা জায়গায় গল্প ফেলার সহজ পদ্ধতিতে না গিয়ে ব্রিটিশ প্রেক্ষাপটে গল্প রাখলে কেন?

সায়ন্তন: আমি ওই সাহেবীয়ানাটা রেখেই কাজটা করতে চেয়েছি। তার কারণ শার্লক হোমসকে আমি ওর বাইরে কোনওদিন ভাবতে পারিনি। হোমস মানেই তার সমগ্র ব্যাকগ্রাউন্ডটা সেখানে থাকবে। তাকে বাঙালি কোনও চরিত্র করে বা গল্পটাকে কলকাতায় এনে দেখাবার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। যেমন ব্যোমকেশ বক্সিকে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনওভাবে দেখানো যায় না তেমনই আমার মনে হয় শার্লক হোমসকেও তার নিজের জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও মানায় না। তাই এই চ্যালেঞ্জটা আমি জেনেশুনেই নিয়েছি বলা যায়। নামটা আলাদা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা অবশ্যই একটা জাস্টিফায়েড কারণ রেখেই হয়েছে। সঞ্জীব (বন্দ্যোপাধ্যায়) যেভাবে গল্পটা সাজিয়েছে সেখানে এই নামের গল্পটা কোথাও খাপছাড়া লাগবে না।

প্রশ্ন: গতবছর সৃজিত মুখোপাধ্যায় হিন্দিতে একটা সিরিজ় করেছেন হোমসকে নিয়ে। সেটা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তারপর আবার তোমার কাজটা আসছে। ‘শেখর হোম’কে কতটা প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখছ?

সায়ন্তন: প্রতিযোগিতা আবার কী, সৃজিতদা আমার সিনিয়র। প্রতিযোগিতার কোনও প্রশ্নই নেই। আমার নিজের অনেকদিনের ইচ্ছে বা স্বপ্নের একটা ছবি বলা যায় এটা, সেটা আমি বানিয়েছি। যে যার কাজটা তো নিজের মতো করেই করবে। তাই দুটো কাজ একেবারেই আলাদা হবে অবশ্যই। হ্যাঁ এটা জানি যে একশ্রেণীর লোক ছবিটা না দেখেই উল্টোপাল্টা কথা বলবে। সেগুলো নিয়ে আর ভাবি না। যারা দেখার তারা হলে গিয়ে ছবিটা দেখবেন এটা আমি জানি।

প্রশ্ন: ‘সোনার কেল্লায় যকের ধন’, ‘রবীন্দ্র কাব্য রহস্য’, ‘ম্যাডাম সেনগুপ্ত’ আর এবার আসছে ‘সরলাক্ষ হোমস’, এ বছর অনেকগুলো ছবি এলো তোমার পর-পর। দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন পেলে?

সায়ন্তন: আমার কাছে তো নিজের সব কাজই প্রিয়। তবে যকের ধন মানুষ বেশি দেখেছেন। আর ‘রবীন্দ্র কাব্য রহস্য’ সব ধরনের দর্শকের জন্য ছিল না তাই একটু কম প্রমোশন হয়েছে ছবিটার। ওটা কিছুদিনের মধ্যেই ওটিটি মাধ্যমে চলে আসবে। ‘ম্যাডাম সেনগুপ্ত’ খুব ভালো চলেছে, এখনও চলছে। মানুষ দেখছেন ছবিটা। আর ‘সরলাক্ষ হোমস’ আমার স্বপ্নের ছবি। এখনও অবধি আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি এটাই বলতে পারি। আশা করি দর্শক হলে গিয়ে দেখবেন, পছন্দ করবেন ছবিটা।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *