বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই ‘ছোটলোক’-এর বাজিমাত

ছোটলোক দেখেছ? ইদানিং এই প্রশ্নটা সামাজিক মাধ্যম কিংবা মুখোমুখি আলাপে একটু বেশিই শোনা যাচ্ছে। শুধু এইটুকু শুনে কোনও বহিরাগত যদি একে বাঙালির বর্ণবিদ্বেষ বলে মনে করে তাহলে ডাহা ভুল করবে। আসল ঘটনাটা ঘটিয়েছে ওয়েব সিরিজ় ‘ছোটলোক’। পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। অভিনয়ে দামিনী বেণী বসু, ইন্দ্রাণী হালদার, গৌরব চক্রবর্তী, প্রিয়াঙ্কা সরকার, ঊষসী রায়, প্রতীক দত্ত, লোকনাথ দে, ঊষসী চক্রবর্তী, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, শুভ্রজিত দত্ত, সুমিত সমাদ্দার ও সঞ্জীব সরকার। লোকমুখে এই সিরিজ়ের নাম শুনে দেখে ফেলেছেন বা দেখব বলে মনস্থ করেছেন এমন দর্শকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বাংলার গোয়েন্দা ও থ্রিলার সর্বস্ব সিরিজ় দুনিয়ায় প্রথমবার কোনও সিরিজ জনমানসে এতটা দাগ কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কেন? থ্রিলারপ্রেমী বাঙালির সিরিজ় মানেই তো রহস্যের পিছনে দৌড়নো। এমনও নয় যে লকডাউন পরবর্তী সময়ে সিরিজ়ের ভিড়ে দর্শকের প্রাপ্তির ঝুলি একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। তবু ‘ছোটলোক’ এমন কিছু এনে দিয়েছে যা আমরা আগে দেখিনি। অন্তত বাংলায় তো নয়ই।

এই সিরিজ়ের প্রধান অস্ত্র দুটি। এক, এর ন্যারেটিভ। গল্প নন-লিনিয়র পথে চললেও চরিত্রগুলোকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাতে করে কোথাও সেই মুহূর্তের সঙ্গে রিলেট করতে অসুবিধা হয় না। গল্প বলার ধরন কোথাও দর্শককে বিভ্রান্ত করে না বা ধোঁয়াশায় রাখে না। বাড়তি টেনশন বা জাম্পকাটের চমক নেই। যা আছে তা হলো গুছিয়ে গল্প বলা। স্লো বার্ন থ্রিলারের মজা এখানেই। বিরাট কোনও ধাক্কা না দিয়েও টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার ক্ষমতা এবং দরকারে সেই গতিতে রাশ টানা, দুটোই দক্ষ পরিচালনার লক্ষণ।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

অস্ত্র দুই, চিত্রনাট্যের বাস্তবতা। এই সিরিজ়ে কোথাও ঝাঁ চকচকে সেট, গ্ল্যামারাস চরিত্র কিংবা দুর্দান্ত ফ্রেম পাওয়া যাবে না। কারণ বাস্তবের মাটিতে পা রেখে এই গল্প আমাদের রোজকার জীবনের কথা বলে। যেভাবে পাড়ায় কোনও ঘটনা ঘটলে লোক জমায়েত হয়, পুলিশ আসে, নিজের ছন্দে কেস এগোয়, ঠিক সেভাবেই এগিয়েছে গল্পের গতি। গল্পের নায়ক-নায়িকারাও যেমন সদ্য বিউটি পার্লারের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসেনি তেমনই পুলিশও একেবারে বাস্তবের মতোই বিরক্তিকর, ভয় ধরানো। এইখানেই ‘ছোটলোক’ গড়পড়তা আর পাঁচটা সিরিজ়কে টেক্কা দিয়েছে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবন থেকে নিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রা এবং উচ্চকোটির রাজনৈতিক রোজনামচা সবটাই গল্পে এসেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। যেভাবে আমরা প্রতিদিনের জীবনকে দেখি সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজ দেখায় এই সিরিজ়।

আরও পড়ুন: এত ‘অরণ্য’ কেন?

সবথেকে বেশি নজর কেড়ে নেয় সাবইন্সপেক্টর সাবিত্রী মণ্ডলের চরিত্রায়ন। বাংলা সিরিজ় যেখানে মহিলা পুলিশ মানেই আকর্ষণীয় ফিগার এবং ফ্যাশনের যুগলবন্দী দেখাতে সিদ্ধহস্ত, সেখানে সাবিত্রী একেবারেই আমাদের চেনা ধর্মতলায় মিটিং-মিছিলে দেখতে পাওয়া গম্ভীর মুখের খুব সাধারণ একজন পুলিশকর্মী। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় টাইট করে বাঁধা বেড়া বিনুনি, তেলতেলে মুখ এবং একটি লাল টিপ, এই বেশে বাংলায় কোনও সিরিজের নায়িকাকে দেখা গেছে চেষ্টা করেও মনে করা যাবে না। যিনি সকালে থানায় গিয়ে অপরাধীকে কড়কে আবার সন্ধেবেলায় বাজার করে বাড়ি ফেরেন, তিনি আমার-আপনার পাড়ার যে কেউ হতে পারেন। পুলিশের পোশাক তার ব্যক্তিত্ব এবং স্ট্যাটাসে কোনও আলাদা মাত্রা যোগ করে না। পুলিশ হয়েও যিনি মর্গের পরিবেশ নিতে পারেন না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চুরমুর বা ফুচকা খেতে অভ্যস্ত, বাড়িতে বাচ্চাদের শাসন এবং স্বামীর সঙ্গে গল্প না করলে যার চলে না, সেই সাবিত্রী আমাদের কাছে অপরিচিত নয়, আর সেটাই এই চরিত্রের ট্রাম্প কার্ড। খুব সাধারণ হয়েও অনন্য এক চরিত্র। যে নিজের হাতে আসা কেস বাঁচাতে হঠাৎই প্রবল ঝুঁকি নিতে পারে, আবার মেয়ের স্কুলে গিয়ে একটিমাত্র বাক্যে বুঝিয়ে দেয় শিশুদের জন্য ঠিক কতখানি শাসন প্রয়োজন। সাবিত্রীর চরিত্রে দামিনী অনবদ্য। কোথাও এতটুকু ওভারঅ্যাক্টিং তো নয়ই, আন্ডারঅ্যাক্টিংও নেই। ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই।

অন্যান্য চরিত্রে চমকে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন প্রায় প্রত্যেকে। যার মধ্যে প্রতীক, লোকনাথ, দেবেশ, সঞ্জীবের নাম উল্লেখযোগ্য এবং ছোট চরিত্রের আরও অনেকে।

বাস্তবের মাটিতে পা

হিন্দিতে এই মুহুর্তে যে সমস্ত ওয়েব সিরিজ় দেখতে আমরা অভ্যস্ত, বা যারা মুগ্ধ করছেন, তাদের মূল হাতিয়ার এই বাস্তবের কাছাকাছি থাকা। কোথাও এতটুকু বাহুল্য না রেখে গল্পের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই একই ধারা অবলম্বন করে ইন্দ্রনীলও দেখিয়ে দিয়েছেন পাঁচঘণ্টার সিরিজ়ে কীভাবে টানটান রহস্যের জাল খোলা যায়।

এছাড়াও সিরিজ়ের অন্য ধরনের নামকরণ নির্দেশ করে সমাজের এমন এক প্রায় লুকিয়ে রাখা বৈষম্যকে যার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। একটি দৃশ্যে এক সহকর্মী সাবিত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কোটায় চাকরি পেয়েছে। বাঙালি সমাজে জাতপাত ভেদাভেদ না থাকলেও আজও খুব নির্লজ্জভাবে রয়ে গেছে উচ্চ-নীচ বৈষম্য। যদিও সেটাকেও স্বভাববশত আমরা ঢেকে রাখি। তবু বালির নিচে অন্তঃসলিলার মতো করেই বয়ে চলে ক্ষোভের ধারা, জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুন। সময় এলে তারাও মাথাচাড়া দিতে পারে, মনে রাখা দরকার।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *