‘ছোট অভিনয় বলে কিছু হয় না’
থিয়েটার, টেলিভিশন, বা ছবির পর্দা, বিনোদনের সব মাধ্যমেই তাঁর অবাধ বিচরণ। সাদা বা কালো, যে কোনও চরিত্রেই বলিষ্ঠ অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য রূপে প্রমাণ করেছেন বারবার। কখনও তিনি মঞ্চ কাঁপানো বক্তিয়ার খিলজি, ‘কৃষ্ণকলি’র ভালোমানুষ কৃষ্ণচরণ কিংবা ‘করুণাময়ী রানী রাসমনি’র তুখোড় ব্রাহ্মণ শিরোমনি তর্কালঙ্কার, আবার কখনও বা ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’র দুর্ধর্ষ শিকারি মাধবলাল, যে কোনও ভূমিকাতেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন সঞ্জীব সরকার। সম্প্রতি তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘ভটভটি’র শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় পর্বে পাকড়াও করা গেল তাঁকে। নিজের অভিনয় জীবন নিয়ে নানান কথা জানালেন রেডিওবাংলানেট-কে।
কখনও নিরীহ ভালোমানুষ আবার কখনও ভয়ঙ্কর কুটিল, যে কোনও চরিত্রেই আপনাকে সাবলীলভাবে পাওয়া যায়। অর্থাৎ চরিত্রের বাছবিছার আপনি করেন না। কিন্তু একটা চরিত্র করবেন কি না, সেটা বাছাই করেন কীভাবে?
একটা বিচার তো করতেই হয়, যে চরিত্রটা কেমন। তবে ভালো না খারাপ সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। আমি একটাই জিনিস বিচার করি যে কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে আমার চরিত্রের সামগ্রিক বক্তব্যটা কী? সেই বক্তব্য ঠিক না ভুল সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু সেই বক্তব্যের ওই কাহিনীতে কী ভূমিকা রয়েছে সেটা অবশ্যই বিচার্য। সেই বক্তব্যটা যদি যথাযথ হয় তখন কাজটা করতে অবশ্যই খুব ভালো লাগে। আমি বিশ্বাস করি ছোট অভিনেতা হতে পারে, ছোট অভিনয় বলে কিছু হয় না। তাই যে কোনও চরিত্রই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে হ্যাঁ, যদি সেই চরিত্রের গল্পে বিশেষ কোনও ভূমিকা না থাকে সেক্ষেত্রে সেই কাজটা করার ইচ্ছে থাকে না।
যে কোনও চরিত্রের জন্য আলাদাভাবে কোনও প্রস্তুতি থাকে কি? চরিত্রের ম্যানারিজ়ম কীভাবে নিজের মধ্যে গড়ে তোলেন?
প্রস্তুতি বলতে আমি যেহেতু থিয়েটার করি, তাই সেখানেই একটা নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়। থিয়েটার তো সিনেমার মতো নয়। সেখানে ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলে তারপর মনিটর দেখে নিয়ে আবার একটা টেক করলাম, সেটার সুযোগ নেই। থিয়েটারে দীর্ঘদিন ধরে মহড়া দিতে দিতে চরিত্রটাকে একটা পারফেকশনের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই প্রক্রিয়াটা কোথাও যেন আমার জীবনচর্যার সঙ্গে মিশে গেছে। মঞ্চে আমাকে নানাবিধ চরিত্রে অভিনয় করতে হয়, সেটা আমি ভালোবাসি। সেগুলো করতে গিয়েই আমার এই হোমওয়র্কটা হয়ে যায়। সেটার প্রতিফলন আমার কাজে পড়ে। চরিত্রের ম্যানারিজম কি হবে সেটা পরিচালক বা চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ডই ঠিক করে দেয়। যেখানে যেমন প্রয়োজন, আমি সেইভাবে কাজটা করি।
আরও পড়ুন: তাশি গাঁওয়ে একদিন
একটা চেনাজানা চরিত্র না কি ঐতিহাসিক বা লার্জার দ্যান লাইফ, কোন ভূমিকায় অভিনয় করাটা বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়?
কঠিন সেভাবে কোনওটাই লাগে না। তবে যেগুলো নিয়ে একটু খাটাখাটি করতে হয় সেগুলো বেশীরভাগই নেগেটিভ চরিত্র। তবে সব সময় তাও নয় জানেন। যখন একটা ঐতিহাসিক চরিত্র করি, তখন তার মধ্যে আমার নিজস্ব ইনপুট খুব বেশী থাকে না। কেন না সেক্ষেত্রে যখন আমি চাণক্য করছি বা বিদ্যাসাগর করছি, আমাকে সেই চরিত্রটার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে হয়। চরিত্রটাকে জেনে, সেই সম্বন্ধে পড়াশোনা করে সেভাবেই কাজটা করতে হয়। কিন্তু যখন এমন কোনও চরিত্র করি যেটা সচরাচর দেখা যায় না বা আমরা আমাদের চারপাশে খুঁজে পাই না, সেখানে নিজেকে খেটে সেই কাজটা বার করে আনতে হয়। সেটা সব সময়েই চ্যালেঞ্জিং আর তা করার মধ্যে মজা আছে। কল্পনার আশ্রয় নিয়ে সেই লোকটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এটা করতে ভাবনাচিন্তা লাগে।
টেলিভিশন না সিনেমা, কোনটা বেশী পছন্দের?
দুটোই আমার কাছে একই রকম, বিশেষ করে আজকের দিনে। দুটোই পর্দার ব্যাপার। একটা কথা বলি, খুব দুঃখের জায়গা থেকে। আমার ছোটবেলায় দেখা একটা খুব চেনা দৃশ্য, বাড়ির সকলে মিলে সিনেমা যাওয়া। সেই যাওয়ার একটা বিশেষ প্রস্তুতি থাকতো, মা কাকিমা বাবা কাকারা মিলে। তার একটা আলাদা আনন্দ বা উচ্ছ্বাস থাকতো । সেই ব্যাপারটা এখন হারিয়ে গেছে। এখন লোকে সিনেমাটাও ওই টিভির পর্দাতেই দেখে। অনলাইন স্ট্রিমিং সাইটগুলো এসে গিয়ে সিনেমার মাহাত্ম্যও যেন কোথাও কমে গিয়েছে। ফলে সিনেমা দেখার যে মানসিক প্রস্তুতিটা আগে করতে হতো, এখন আর সেটা নেই। তবে সিনেমার একটা আর্কাইভাল ভ্যালু তো আছেই। সিনেমার চরিত্রকে মানুষ মনে রাখে। তাই কিছুটা হলেও সিনেমা একটু বেশী প্রিয়।
আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
ছবি বা টেলিভিশনকে ছাপিয়েও আপনি থিয়েটারের অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশী পরিচিত। এটা কতটা তৃপ্তিদায়ক?
ভীষণ তৃপ্তিদায়ক। থিয়েটারে যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়, সেখানে দর্শকের সঙ্গে লাইভ ইন্টার্যাকশনের সুযোগ থাকে যেটা আর কোনও মাধ্যমে নেই। থিয়েটারে নাটকীয়তা অনেক বেশী, নিজের সমস্তটা দিয়ে অভিনয় করার পরে কিছু অসাধারণ মুহূর্ত বা তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ওই সময়ে তৈরি হয়ে আবার তখনই মিলিয়ে যায়। খুব স্বল্পমেয়াদী বলেই ওই মুহূর্তগুলো একজন অভিনেতার কাছে খুব দামী। আর প্রতিবারেই একটা চরিত্রে অভিনয় সেখানে নতুন একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। কোনও দুটো অভিনয় হুবহু এক হতে পারে না। তাই বৈচিত্র্যের দিক থেকে একজন অভিনেতাকে সব সময় চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একমাত্র থিয়েটারেই।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
আগামীদিনে কোন কোন ছবি, মেগা বা নাটকে দেখা যাবে আপনাকে?
তথাগতর ‘ভটভটি’ তো করছি। ওর সঙ্গে এটা আমার দ্বিতীয় কাজ। এর আগে তথার সঙ্গে ‘ওয়াটারবটল’ বলে একটা ওয়েব সিরিজ়ে কাজ করেছি। ওকে আমি আগে অভিনেতা হিসেবে চিনতাম। পরিচালক হিসেবে তথাকে দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি। অভিনেতা ও পরিচালক, এই দুটো জায়গায় ও যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। ওর কাজ আমার এত ভালো লেগেছিল যে মেগা ও নাটক নিয়ে এত ব্যস্ততা থাকা সত্বেও ওর ছবিতে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে রয়েছি।
কোন চরিত্রে থাকছেন ‘ভটভটি’তে?
এখানে আমি একজন মারম্যান বা মৎস্যমানব। এর বেশি এখনই কিছু বলব না। তবে এরকম কোনও চরিত্র আগে করিনি, তাই এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা কাজ হতে চলেছে। এছাড়া অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা ছবি করলাম। রাজা চন্দর সঙ্গেও একটা করেছি। আর মেগার কাজ তো চলতেই থাকে। ‘কৃষ্ণকলি’, ‘করুণাময়ী রানী রাসমনি’, ‘চিরদিনই আমি যে তোমার’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘মা সারদা’ চলছে এই মুহূর্তে। নাটকও চলছে বেশ কয়েকটা, যেমন ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘হন্তারক’, ‘ধর্মাশোক’, ‘তথাগত’, ‘দ্য গ্রেট নিউ লাইফ’, ‘অনাহুত’, ‘চতুষ্পাপ’, ‘তুষের আগুন’ ও ‘কৃষ্ণপক্ষ’। এছাড়া দুটো নতুন নাটক শুরু হতে চলেছে, ‘ধর্মায়ুধ’ ও ‘লম্বকর্ণ পালা’।
ছবি: প্রতিবেদক