অতৃপ্তি, যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষ

ছবি: রবিবার

পরিচালনা: অতনু ঘোষ

অভিনয়ে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, জয়া আহসান, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৮ মিনিট

RBN রেটিং: ২.৫/৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ অর্থাৎ এমন একটা গল্প যেখানে বর্ণনার ছটা নেই, নেই ঘটনার বিশেষ কোনও ঘনঘটা। তবুও সেই গল্পের পরিসমাপ্তি যেন মনের গোপন খাঁজ খোঁজে। উদ্রেক হয় অনেক প্রশ্নের যা গল্পশেষে উত্তরবিহীন হয়ে থেকে যায় পাঠকের মননে ও চিন্তনে।




‘সোনার তরী’র প্রসঙ্গ খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে হাজির হয় অতনুর ‘রবিবার’ দেখার পর। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ভালোবাসেন সম্পর্কের গল্প বলতে। তাঁর ছবিতে মানুষের মধ্যে থাকা সম্পর্কের জটিল দিকগুলি ক্রমশ উন্মোচিত হয়। দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠা মনের কারণে সম্পর্কে বাড়ছে দূরত্ব, কোনঠাসা হয়ে পড়ছে সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভূতিগুলো।

‘রবিবার’ শুরু হয় এক রবিবারের সকাল দিয়ে। পেশায় কর্পোরেট আইনজীবি সায়নী (জয়া) একজন লেখিকাও বটে। নিজের বাড়িতে একা থাকেন এবং প্রত্যেক রবিবার পছন্দের রেস্তোরাঁয় গিয়ে জলযোগ সারেন। এহেন এক মেঘলা রবিবারে সেই রেস্তোরাঁয় ঢুকে সবেমাত্র বসেছে সায়নী, অকস্মাৎ এসে হাজির তার পুরোনো প্রেমিক অসীমাভ (প্রসেনজিৎ)। পনেরো বছর পর সায়নীকে দেখে রেস্তোরাঁ থেকে তাকে প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে বেরিয়ে পরে অসীমাভ। সায়নী এসে উপস্থিত হয় অসীমাভর বাড়িতে। সেই চেনা বাড়ি, চেনা ঘর সবই তার বড্ড আপন হলেও একটু যেন ইতস্তত করে সে।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

স্ত্রীর মৃত্যুর পর একাই থাকে অসীমাভ। হঠাৎই সে নিজের আলমারি খুলে ব্যক্তিগত কাগজপত্রের সন্ধান জানাতে থাকে সায়নীকে। কিন্তু কেন? তবে কি তাদের দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক নয়? তবে কি অসীমাভ জেনেবুঝেই সায়নীর সঙ্গে আজ সকালে সাক্ষাৎ করেছে?

সায়নী-অসীমাভর বিচ্ছেদের কারণ অসীমাভর ধোঁকাবাজির খেলা। লোক ঠকানো, মিথ্যে কথা বলা, সই জাল, সবকিছুতেই সে সিদ্ধহস্ত। পুলিশের ডায়েরিতে তার নামে ন’টি অভিযোগ রয়েছে। এই অপরাধমনস্ক অসীমাভকে সায়নীর অসহ্য লাগলেও সে ছেড়ে যেতে পারে না। যে কারণগুলোর জন্য একদিন তাদের প্রেম পূর্ণতা পায়নি, সেগুলোই সায়নীর কাছে তুরুপের তাস হয়ে ওঠে। সায়নীর সদ্য শেষ করা বইটিকে আরও বাস্তবধর্মী করার জন্য তার প্রয়োজন এরকমই একজন মানুষের সাক্ষাৎকার। তাই সে অসীমাভর কাছে একটি শর্ত রাখে। অসীমাভর বিরুদ্ধে থাকা সমস্ত অভিযোগের আইনী দেখভাল সে নিজের হাতে তুলে নেবে। পরিবর্তে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত অপরাধের ঘটনা সায়নীকে জানাতে হবে। অর্থাৎ ভালোবাসা হারতে থাকে স্বার্থসিদ্ধির বেড়াজালে। লোভ কার নেই? 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

গল্প বলার ক্ষেত্রে কোনও তাড়াহুড়ো করেননি অতনু। নিজ লয়ে, ধীরে সুস্থে এগিয়েছে ছবি। বিদেশি ছবির গল্পের ধাঁচে চিত্রনাট্য লিখেছেন অতনু নিজেই। অভিনয়ে প্রসেনজিৎ এবং জয়া দুজনেই প্রশংসার দাবি রাখেন। এই প্রসেনজিৎকে বাঙালি দর্শক আগে দেখেননি। বেশ কিছু জায়গায় জয়ার উদাসীন অভিব্যক্তি তারিফযোগ্য। শিশুশিল্পী শ্রীজাতর অভিনয় আরও একবার চমক লাগানোর মতো। এর আগে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সোনার পাহাড়’-এ শ্রীজাতর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় দর্শকদের মন কেড়েছিল।

দেবজ্যোতি মিশ্র পরিচালিত আবহ সঙ্গীত বেশ মনোমুগ্ধকর। গল্পের মতোই সেখানেও কনটেম্পোরারি ছোঁওয়া পাওয়া যায়। ছবির শুরুতে রূপঙ্কর বাগচীর কণ্ঠে ‘তোমায় মনে পড়ছিল’ গানটি শুনতে ভালো লাগে।

আরও পড়ুন: সাইকেল গ্যারেজে পরিণত ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি

এবার আসা যাক অতৃপ্তিতে। সত্যি বলতে কি ‘রবিবার’ সবার জন্য নয়। অনেক দর্শকের মনেই হয়তো এই ছবি সেভাবে দাগ কাটবে না। চরিত্রগুলির সঙ্গে দর্শকের সেভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই ছবি শেষ হয়ে যায়। যদি বলা হয় ‘রবিবার’ আপনাকে ভাবাবে, তাহলেও সেই ভাবনারাও যেন দিশাহীন। কেন অসীমাভ হঠাৎ সায়নীকে তার বাড়িতে আনল? কেনই বা সুপারি কিলার ভাড়া করল সে? সবকিছুই যেন ভীষণভাবে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল শেষে। অতনুর পরিচালিত ‘ময়ূরাক্ষী’ যেভাবে আশা জাগিয়েছিল দর্শকমহলে, সেটা অনেকটাই নিরাশায় পরিণত হয় ‘রবিবার’ দেখে। গল্পের টানটান বুনোট ভীষণভাবে অনুপস্থিত ছবিজুড়ে।

তাই শেষ হয়েও ঠিক শেষ হয় না এই ছবি। অন্য এক গল্প শুরুর রেশ জাগিয়ে টাইটেল কার্ড উঠতে শুরু হয় পর্দায়। এই ছবিকে কখনওই ভালো-খারাপের তকমা দেওয়া যায় না। বরং আধুনিকতার মোড়কে, বাঙালিয়ানা মাখানো একটি এক্সপেরিমেন্টাল ছবি বলা যায় ‘রবিবার’কে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *