‘আমাকে বোধহয় কেউ মনে রাখেনি’
বড় পর্দায় বাঙালির সেই বোধহয় প্রথম সিক্স প্যাক দর্শন। বডিবিল্ডিং–এর খুঁটিনাটি কিছু না জেনেও দর্শক জেনে ফেলল ভাত চিবোতে গেলে বা ভুরু নাচাতে গেলেও মাংশপেশী সঞ্চালনের প্রয়োজন। বাইসেপ, ট্রাইসেপ আর ডেল্টয়েড–এর অর্থ শরীরচর্চা বিমুখ বাঙালিকে তিনিই প্রথম এমন সহজভাবে বোঝালেন। একটিমাত্র ছবিতে অভিনয় করে কিংবদন্তি বনে যাওয়া মলয় রায় ওরফে গুণময় বাগচীকে ফোনের ওপারে পাওয়া কম ভাগ্যের নয়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মুক্তির চল্লিশ বছর পর শ্যুটিং ও নিজের সম্পর্কে নানান কথা জানালেন বিশ্বশ্রী।
প্রথম থেকেই শরীরচর্চা ভালো লাগত নাকি পিতা মনতোষ রায়ের ইচ্ছেতেই করতেন?
বাবাকে দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। বাবার গুরু বিষ্টুচরণ ঘোষ আসতেন আমাদের বাড়িতে। এনাদের দেখেই আমার শরীরচর্চা করার ইচ্ছে হয়।
গুণময় বাগচীর বাইসেপ আর ট্রাইসেপের মাপ তো আজও বাঙালির মুখস্থ। ছবিতে ওই মাপগুলো যা বলা হয়েছিল তখন কি আপনার সত্যিই তাই ছিল?
হ্যাঁ তখন তাই ছিল আমার। সত্যজিৎ রায় জেনে নিয়েছিলেন মাপগুলো।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
সত্যজিতের সঙ্গে যোগাযোগ হল কিভাবে?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ব্যায়াম করাতেন আমার বাবা। সৌমিত্রদা একদিন বললেন, একজন বডিবিল্ডার দরকার, সত্যজিতের নতুন ছবির জন্য। বাবা তখন আমার নাম করেন। সৌমিত্রদা আমাকে নিয়ে গেলেন বিশপ লেফ্রয় রোডে।
প্রথম অবস্থায় ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলতে অস্বস্তি হয়নি?
খুবই অস্বস্তি হয়েছিল। আমি তো কোনওদিন এসব করিনি। আমি ওনাকে দুটো জিনিস বললাম। এক, ‘আপনি আমার বাবার বয়সী, তাই আমি আপনাকে জ্যেঠু বলব। আপনার আপত্তি নেই তো?’ উনি বললেন, ‘কোনও আপত্তি নেই।’ আর যেটা বললাম সেটা হল, ‘আমি কোনওদিন নাটকে অভিনয় করিনি। তাই আমার ভুল হতে পারে। আপনাকে কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে। শিখিয়ে দেবেন। ভুল হলে রেগে যাবেন না।’
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
রেগে গেছিলেন উনি?
একেবারেই না। বললেন, ‘আমি যা করব, সেই দেখে তুমি করবে, তাহলেই হবে।’ আমি সেইভাবেই করতাম।
সৌমিত্র নাকি সন্তোষ দত্ত, কে বেশি সাহায্য করতেন অভিনয়ের সময়?
সকলেই সাহায্য করতেন। ক্যামেরা অফ থাকলে অনেকেই দেখিয়ে দিতেন কিভাবে করতে হবে সিনটা। সৌমিত্রদাও দেখিয়ে দিয়েছেন, সন্তোষদাও। তবে সন্তোষদাকে আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব ভালো লাগত। খুব সহজভাবে অভিনয় করতেন উনি। কখনওই ভয় করত না।
কিভাবে নির্দেশ দিতেন সত্যজিৎ? আপনার ওপর ছেড়ে দিতেন, নাকি দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিতেন?
উনি পুরোটা নিজে করে দেখিয়ে দিতেন। কিভাবে মাসল দেখাতে হবে সেটাও আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে ভালো অভিনেতা ছিলেন। উনি দেখিয়ে দিলে তারপরে আমি করতাম। কথা দিয়েছিলেন, তাই ভুল হলেও রাগতেন না কখনও। আরেকবার করতে বলতেন।
কতদিন চলেছিল আপনাকে নিয়ে ছবির শ্যুটিং?
ওই ২০-২২ দিন মত হবে।
সত্যজিৎ ও রেলভূত
আপনার তো নিজের জিম আছে। শরীরচর্চাকেই কি আপনি পেশা হিসেবে বেছে নেন?
না, না। আমি তো আয়কর দপ্তরে চাকরি করতাম। তারপরে ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতেও ছিলাম বেশ কিছুদিন। এখন বিটি রোডে, ডানলপের কাছে আমার জিম আছে। এটাই এখন আমার পেশা।
জয়বাবা ফেলুনাথ-এর পর আর কোনও ছবিতে আপনাকে দেখা গেল না কেন?
সেটা আমিও ঠিক জানি না। আমার কিন্তু কাজ করার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন টালিগঞ্জে ঘোরাঘুরিও করেছিলাম। কিন্তু কোনও পরিচালকই তেমন পাত্তা দিলেন না। সেটা কেন আমি জানি না। হয়ত যতটা তেল দিতে হত সেটা আমি করতে পারিনি।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
আপনাকে একেবারেই লাইমলাইটে দেখা যায় না। সত্যজিতের সঙ্গে সামান্য কাজ করা অনেককেই অনেক অনুষ্ঠানে দেখা যায়। আপনার গুণময় বাগচী চরিত্রটা কিন্তু আজও কাল্ট হয়ে রয়েছে সকলের কাছে। তবুও সত্যজিৎ সম্পর্কিত কোনও অনুষ্ঠানে আপনাকে দেখা যায় না কেন?
এটাও আমি জানি না (হেসে)। একবার ওনাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে অনেকে এসেছিলেন। সৌমিত্রদাও এসেছিলেন। আমাকে কেউ ডাকেনি। আমি বাবুদাকে (সন্দীপ রায়) ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমাকে ডাকা হল না কেন? উনি বললেন আমার ফোন নম্বর ছিল না ওনার কাছে। তখন ওনাকে আমার ফোন নম্বর দিই। তবে তারপরেও কোনও জায়গা থেকে ডাক পাইনি আমি। আমাকে বোধহয় কেউ মনে রাখেনি।
‘মগজাস্ত্র’ ওয়েব ম্যাগে প্রথম প্রকাশিত
ছবি: মলয় রায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে