বাঙালির ফুটবল প্রেমকে উস্কে দিয়ে
ছবি: গোলন্দাজ
পরিচালক: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়ে: দেব, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ইশা সাহা, ইন্দ্রাশিস রায়, শ্রীকান্ত আচার্য, জন ভট্টাচার্য, অগ্নি, উজান চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য (২), ইন্দ্রজিৎ মজুমদার, অ্যালেক্স ও’নিল।
দৈর্ঘ্য: ১৪৯ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
সিনেমার কাজ গল্প বলা। অচেনা অজানা একটা গল্পকে সেলুলয়েডের সুন্দর বুনোটে বেঁধে ফেলার নামই সিনেমা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়’। সিনেমাও সেই কাজটাই করে, তবে আরও বড় মাত্রায়, বিশাল ক্যানভাসে। সেই কারণেই একটা ঐতিহাসিক নাটক নামানো যতটা সহজ, ততটাই কঠিন কোনও ঐতিহাসিক গল্প বা জীবনী অবলম্বনে সিনেমা তৈরি করা। সেই কাজটা মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে করে ফেলেছেন ‘গোলন্দাজ’-এর পরিচালক। ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর জীবনের নানা গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবিতে দিনের শেষে প্রাপ্তি হলো সে যুগের একটুকরো বাংলা।
যে সময়ে ভিস্তিওয়ালা সকালে রাস্তায় জল দিত, ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলতো বা রানার চিঠিপত্র বিলি করতো এ গল্প সেই সময়ের। এ সবই খুব সচেতনভাবে ছবিতে রাখা হয়েছে। এমনকি সিমলার নরেনের কুস্তি লড়া দেখে ছোট্ট নগেন্দ্রর উদ্বুদ্ধ হওয়ার ঘটনাও দর্শককে চমৎকৃত করবে। ময়দানে গোরা সৈন্যদের ফুটবল দেখে নগেন্দ্ররও খেলতে ইচ্ছে হয়। সে রাগবি বল নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে হইচই করে খেলতে নেমে পড়ে। বড় হওয়ার পর শুধু খেলাধুলা নয়, সাহিত্যের প্রতিও অনুরাগী হয়ে ওঠেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে বঙ্গানুবাদ করেন তিনি। এছাড়া উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘টেম্পেস্ট’ ও ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এর অনুবাদের কাজও শেষ করেছিলেন তিনি। যদিও শেক্সপিয়ারের অনুবাদককে ছবির কোথাও সাহেবদের কথার উত্তরে ইংরেজি বলতে শোনা গেল না।
যাই হোক, মেজর জ্যাকসনের দাপটে ভারতীয়দের ফুটবলে লাথি মারার স্বপ্ন যখন প্রায় অধরাই থেকে যাবে মনে হচ্ছিল, তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই নগেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর তিনটি ক্লাব বয়েজ়, ফ্রেন্ডস ও প্রেসিডেন্সি মিলে তৈরি করেন ওয়েলিংটন ক্লাব। কিন্তু নগেন্দ্রর টিমে কামার মণিদাস, মাঝি সুরদাস থেকে শুরু করে জটা, দুখীরাম, পুরোহিত একে-একে প্রায় সব জাতের মানুষ খেলতে আসায় জাতপাতের দোহাই দিয়ে সমাজের তরফে আপত্তি উঠলে বিরক্ত হয়ে ক্লাব ভেঙে দেন নগেন্দ্র নিজেই। এরপর ক্রমে শোভাবাজার রাজবাড়ির মেয়ে কৃষ্ণকমলিনীর সঙ্গে বিয়ে ও শ্বশুর আনন্দকৃষ্ণ দেব ও কোচবিহারের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শোভাবাজার ক্লাবে নগেন্দ্র ও তার দলের খেলা শুরু হয়। ক্রমশ এভাবেই ১৮৯২ সালে ইংরেজ সামরিক দলের টুর্নামেন্ট ট্রেডস কাপে খেলার প্রস্তুতি শুরু করে নগেন্দ্রর দল।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
ছবির গল্প অবশ্যই নগেন্দ্রপ্রসাদের জীবনের একাধিক ঘটনার মাধ্যমে প্রাচীন বঙ্গ জীবনের কিছু অংশকে তুলে ধরে। তবে সেক্ষেত্রে সর্বত্র ইতিহাস রক্ষিত হয়েছে কিনা সন্দেহ থেকে যায়। নগেন্দ্র নিজে যে সমস্ত ক্লাব তৈরি করেছিল, তার কোনওটার নামই বাংলায় ছিল না, তবু ওয়েলিংটন ক্লাব তৈরির সময় ইংরেজি নাম নিয়ে তার আপত্তির কারণ কী তা বোঝা গেল না। নগেন্দ্রপ্রসাদের পুরোনো ছবি যা দেখা যায়, সবেতেই তাঁর চেহারা সাধারণ বাঙালিদের মতোই। ছবিতে এমন বিশাল চেহারার নগেন্দ্রকে দেখানোর প্রয়োজন ছিল না। কুস্তিগির মানেই সিক্স প্যাকের অধিকারী হওয়া নয়। উপরন্তু ফুটবল খেলতে গেলে ওরকম চেহারার দরকার পড়ে না। এ ছাড়াও টিমের প্র্যাকটিসের সময় বাকি সমস্ত খেলোয়াড়রা যেভাবে গা ঘামিয়ে দৌড়ঝাঁপ করল সেভাবে নগেন্দ্রকে অনুশীলন করতে দেখা গেল না একবারও। ওই প্র্যাকটিস ছাড়া ফিটনেস আসা সম্ভব নয়।
ছবিতে দেখা যায় ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন নগেন্দ্রকে অ্যারেস্ট করে জেলে ঢোকানো হলো। সেখান থেকে চিত্তরঞ্জন দাসের সহায়তায় বেরিয়ে এসে চোখের সামনে নাড়ুর মৃত্যুর ঘটনা দেখার পরেও মাঠে গিয়ে সেকেন্ড হাফে বীর বিক্রমে নগেন্দ্রর খেলতে নামা একটু হলেও অবাক করে। আর সেকেন্ড হাফে খেলোয়াড়রা মাঠে নেমে মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। ক্লাইম্যাক্সের সময় মূল চরিত্রদের গান গেয়ে ওঠা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! ফুটবল মাঠে ওই সময় ওই গান কিছুতেই মানানসই নয়, আর তা ইংরেজরা মুখ বুজে সহ্য করে নেবে এমনটা একটু বেশিই সিনেম্যাটিক স্বাধীনতা দাবি করে। ফাইনাল ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অত্যধিক টানার ফলে ম্যাচ সম্পর্কে একটা সময় দর্শকের আগ্রহ কমে যেতে বাধ্য। ছবির দৈর্ঘ্য বেশ কিছুটা কমানো যেতে পারতো।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
অভিনয়ের প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় দেবের কথা। নিজেকে অনেক ভেঙেছেন তিনি। ‘চাঁদের পাহাড়’ ছবির দেবের সঙ্গে আজকের দেবের প্রায় কোনও তুলনাই চলে না। খুব চেষ্টা করেছেন তিনি নিজেকে নগেন্দ্রপ্রসাদ করে তুলতে। তবে উচ্চারণের ব্যাপারে তাঁকে আরও যত্নবান হতে হবে। ইশা এই ছবির নায়িকা হলেও তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না। সুন্দর সাজে স্বল্প পরিসরে তাঁকে ভালো লাগে।
ভার্গবরূপী অনির্বাণ এক কথায় অনবদ্য, অপ্রতিরোধ্য। মহাদেবের সাজে তাঁর প্রথম আবির্ভাবই বুঝিয়ে দেয় চরিত্রের দরকারে নিজেকে যে কোনও রূপে সাজাতে প্রস্তুত তিনি। ছোট-ছোট কয়েকটি দৃশ্যে তাঁর অভিনয় মনে রেখে দেবার মতো। নাড়ুর চরিত্রে অগ্নি বেশ ভালো। গোবেচারা চরিত্রে খুব ভালো মানিয়ে গিয়েছেন তিনি। মণিদাসের ভূমিকায় উজান অসাধারণ। ক্রমশ এক উজ্জ্বল চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দ্রুত উঠে আসছেন উজান।
আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি ইন্দ্রাশিস। আগাগোড়া ইস্পাত কঠিন চোখ জোড়া দিয়ে মুগ্ধ করেছেন তিনি। ক্যাপ্টেন জিতেন্দ্রকে অনেকদিন মনে থাকবে। নগেন্দ্রর সহকারীর চরিত্রে ইন্দ্রজিৎকে ভালো লেগেছে। জনের অভিনয়ও যথাযথ। এছাড়া নবকুমাররূপে অনির্বাণ বেশ ভালো। হিন্দি ছবিতে এর আগে অ্যালেক্সকে অন্য ধরনের চরিত্র করতেই দেখা গিয়েছে। জ্যাকসনের চরিত্রে তিনি বেশ মানানসই। নগেন্দ্রর বাবা ও মায়ের চরিত্রে শ্রীকান্ত ও তুলিকা মানিয়ে গিয়েছেন। ছোট্ট নগেন্দ্রর চরিত্রে শিশু অভিনেতাকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে।
বিক্রম ঘোষের সুরে ছবির আবহ সঙ্গীত আকর্ষণীয়। কয়েকটি গান শুনতে বেশ ভালো লাগে। তার মধ্যে অন্যতম নির্মাল্য রায়ের কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম’।
ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে নগেন্দ্রপ্রসাদ নামটির সঙ্গে পরিচয় থাকলেও, বাঙালির এমন এক জাতীয় নায়ক সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানার অবকাশ এর আগে সেভাবে হয়ে ওঠেনি। বাঙালির ফুটবল প্রেমকে উস্কে দিতে সফল ‘গোলন্দাজ’। এই ধরনের বিষয়ের ওপর ছবি তৈরি হলে আশা করা যায় নতুন প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে।