লেখক সত্তাটাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করছিলাম: অঞ্জন

পাহাড়ের কোলে ছোট্ট শহরে তারকা অভিনেতার জন্মদিনের পার্টিতেই ঘটে যায় তাঁর মৃত্যু। কিন্তু সেই মৃত্যু কি স্বাভাবিক? নাকি একসময়ের ম্যাটিনি আইডলকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে? উপস্থিত প্রত্যেক নিমন্ত্রিতর ওপর ঘুরে-ঘুরে আসে সন্দেহের তীর। কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে অভিনেতার মৃত্যুর পিছনে? এমনই এক জটিল ও টানটান কাহিনী নিয়ে অঞ্জন দত্ত তৈরি করেছেন তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ় ‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’। প্রথমবার ওয়েব সিরিজ় পরিচালনায় হাত দিলেন অঞ্জন, বললেন নান কথা, শুনল রেডিওবাংলানেট। 

শেষ কয়েক বছর ব্যোমকেশ সিরিজ়ের বাইরে থ্রিলার নিয়ে কাজ করেননি আপনি। হঠাৎ এরকম একটা গল্প লিখলেন কেন? 

আমি একটা সময় প্রচুর থ্রিলার নিয়ে কাজ করেছি। ব্যোমকেশ করার অনেক আগে ‘রুদ্র সেনের ডায়েরি’ করেছি। থ্রিলার গল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালীন। প্রত্যেক সাহিত্যিকেরই প্রায় একটা করে থ্রিলার সিরিজ় থাকেই। আমি নিজেও বরাবরই থ্রিলার কাহিনীর অনুরক্ত ছিলাম। আমি কিন্তু মিউজ়িক্যালের থেকে থ্রিলারই বেশি করেছি আমার কেরিয়ারে। তখন টেলিভিশনের জন্য কাজ করতে গিয়ে রুদ্র সেনকে তৈরি করেছিলাম। তবে সেটা তো অনেক আগের কথা। আবার নতুন করে কোনও একটা গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করাই যায়। আমি নিজে আমেরিকান থ্রিলার পড়ে বড় হয়েছি। এই সিরিজ়টা তৈরি করব ভেবেই গল্পটা আমি লিখি।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’-এ অচেনা দার্জিলিং দেখা যাবে বলছিলেন আপনি  

ঠিক তাই। এটা যে দার্জিলিংয়ের গল্প, সেটা আমি চিনি। সেটা ট্যুরিস্টদের চেনা গড়পড়তা দার্জিলিং নয়। সেখানে মানুষ বসবাস করেন। আমার আগের ছবিগুলোতে চরিত্ররা দার্জিলিংয়ে বেড়াতে বা কাজে গিয়েছে। কিন্তু ওখানে বাঙালিদের বসবাসের একটা ইতিহাস আছে। সেটা খুব কম মানুষই জানেন। সেই দার্জিলিংটাকে আমি চিনি। তাদের নিয়েই আমার গল্প। 

আপনার গল্প, আপনারই পরিচালনা। তবু নিজেকে পরিচালক না বলে ক্রিয়েটর বলতেই পছন্দ করছেন। কেন? 

কারণ একটা ওয়েব সিরিজ় নির্ভর করে তার আইডিয়া ও লেখকের ওপর। পরিচালক পাল্টাতেই পারে। যেমন বিদেশী ওয়েব সিরিজ়গুলোয় প্রতি সিজ়নে পরিচালক পাল্টে যায়। এই গল্পটা আমার মাথা থেকে বেরিয়েছে, সেই জন্য হয়তো আমি পরিচালনা করছি। আমার নিজের কাছে ওয়েব সিরিজ় যিনি লিখছেন—ক্রিয়েট করছেন—তিনিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি যদি ‘এক আকাশের নীচে’র মতো সিরিয়ালকে দেখো, সেখানেও রবি ওঝা প্রথমদিকে কিছুদিন পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তারপর দীর্ঘ সময় ধরে উনি গল্পটা কনসিভ করতেন, এপিসোড পরিচালনা করতেন এক এক সময় এক একজন। কিন্তু ওই ধারাবাহিকটা রবি ওঝারই ব্রেনচাইল্ড। ওঁকে ছাড়া ওই জিনিস হতো না। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

‘মার্ডার ইন দ্য হিলস’-এর এপিসোড সংখ্যা আট। গল্প কি প্রথম সিজ়নেই শেষ হচ্ছে?

হ্যাঁ। তবে দ্বিতীয় সিজ়নে কয়েকটা চরিত্র থেকে যাবে। অন্য কোনও গল্প আসবে। সেখানে সকলে থেকে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে দু-একজন থেকে গেল। তবে দ্বিতীয় সিজ়ন কিন্তু হঠাৎ করেই আসে না। প্রথম সিজ়নেই দ্বিতীয় সিজ়নের সমস্ত সম্ভাবনা রেখে তবেই আমাকে গল্প সাজাতে হয়েছে। সিরিজ় এভাবেই তৈরি হয়। দ্বিতীয় সিজ়ন কেন আসবে তার কারণ প্রথম সিজ়নেই থাকবে। আর সিরিজ়ের ক্ষেত্রে গল্পের সঙ্গে সমান জরুরি হলো চরিত্র। প্রথম সিজ়নে চরিত্রগুলো যদি দর্শকের ভালো লাগে, তবেই তাঁরা পরবর্তী সিজ়নটা দেখবেন। তাই চরিত্রগুলো তৈরি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় সিজ়ন অবশ্যই আসবে, তার গল্পও লেখা হয়ে গেছে। প্রথম সিজ়ন শুট করার সময়েই দ্বিতীয়টার গল্পের কথা মাথায় রেখেই এগিয়েছি। পরের গল্পটাও দার্জিলিংকে নিয়েই।  

ওয়েব সিরিজ় করার পরিকল্পনা কি আপনার আগেই ছিল? নাকি এই সময়ে ছবির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই সিরিজ়ে হাত দিলেন? 

দেখো পরিচালনা, অভিনয়, গান করার পাশাপাশি আমার একটা লেখক সত্তাও আছে। গল্প, চিত্রনাট্য, গান লেখা ছাড়াও একটা সময় আমি সাংবাদিকতা করেছি। নাটকও লিখেছি অন্যের হয়ে। আমার সেই সত্তাটাকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করছিলাম। আর ওয়েব সিরিজ়ের মেকিংটা ছবির মতোই, তবে কাজটা অনেক বড় স্কেলে হয়। একটা সিনেমায় শুধু ঘরের মধ্যে বসে কথা বলে গল্প তৈরি করা যায়। ওয়েব সিরিজ়ে কিন্তু সেটা করা যাবে না। সেখানে অনেক ঘটনা, অনেক অ্যাকশন চাই। নাহলে দর্শককে টেনে রাখা যাবে না। তবে কোভিড কেটে গেলে সিনেমা আবারও ফিরবে।




ডিজিটাল মাধ্যমে এখন প্রচুর কাজ হচ্ছে। এটা নিয়ে আপনি আশাবাদী?

আমার ধারণা কোভিড যদি না হতো, এই অতিমারী যদি নাও আসতো, তাহলেও আর বছর দুয়েকের মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমের এই সুদিন অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোভিড আসার ফলে সেই সময়টা একটু তাড়াতাড়ি হলো, এই যা। তা না হলেও ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে সিনেমা ও সিরিজ় দেখার অভ্যেসটা গোটা পৃথিবীতেই খুব তাড়াতাড়ি আসতো। কারণ নতুন প্রযুক্তি আসবেই। কেউ আটকে রাখতে পারবে না। আমি সময়ের সঙ্গে চলতে ভালোবাসি। তাই সিরিজ়ের প্রতি একটা আগ্রহ আমার ছিল। আর আমি আজ থেকে সিরিজ় দেখছি না। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি। কাজেই এরকম একটা চরিত্র তৈরির কথা আমার মাথায় এসেছিল যে নানা গল্পে ফিরে-ফিরে আসবে। তবে সেটা রুদ্র সেন বা ব্যোমকেশের মতো কেউ নয়। একেবারেই নতুন, সমসাময়িক একটা চরিত্র, বর্তমান প্রজন্মের একজন। 

এতদিন সিনেমা বানিয়েছেন, এবার সিরিজ়। দুটো অভিজ্ঞতায় তফাৎ কতটা আর কোনটা বেশি উপভোগ করলেন? 

দুটো অভিজ্ঞতা আলাদা। সিনেমায় পরিচালকই সব। কিন্তু সিরিজ় একটা টিমওয়ার্ক। এর মধ্যে কোনটা বেশি ভালো সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। আমি দুটোই এনজয় করি। এই সিরিজ়ের ক্ষেত্রে যেমন অনেকেই আমাকে বলেছে এরকম একটা অচেনা দার্জিলিং নিয়ে কাজ করা যায় কিনা, বা একটু অন্যরকম থ্রিলার যদি বানানো যায়, কিংবা নীল আর আপনার গান থাকুক, যে গান আপনার কাছে শুনে এসেছি তার থেকে আলাদা কিছু, এই ইনপুটসগুলো আমাকে ভাবতে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ দার্জিলিং, থ্রিলার, গান, সবই থাকবে কিন্তু তা অন্যভাবে, এতদিন যেভাবে করেছি তার থেকে আলাদা কিছু। এগুলো মাথায় রেখেই আমি কাজটা নিয়ে এগিয়েছি। তাই এটাকে টিমওয়ার্ক বলাই যায়।  

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

কী ধরনের গান থাকছে সিরিজ়ে?

বেশ কয়েকটা গান রয়েছে। ইংরেজি গানও আছে। বাংলা তো আছেই। নেপালি-হিন্দি গান আছে। দেখো, একটা জিনিস বুঝতে হবে যে ওয়েব সিরিজ় এসে ভাষার বেড়াজালটা ভেঙে গেছে। তুমি আজ বাংলা সিরিজ় দেখলে কাল ইংরেজি দেখবে, পরশু তামিল দেখবে, আবার তার আগের দিন হয়তো একটা স্প্যানিশ সিরিজ় দেখেছ। এগুলো এখন আমাদের সকলের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। আমরা সেই ভাষাটা না জেনেও এসব দেখে ফেলছি। আর এই সময়ের বহু আগে আমি যখন ‘চলো লেটস গো’ করেছি, তখনও তাতে ইংরেজি গান ছিল। এখন যখন দার্জিলিংয়ে শুট করছি, সেখানকার মানুষ নিয়ে, তাহলে নেপালি রাখব না কেন? এটা তো ওখানকার বাসিন্দাদের গল্প। কাজেই তাদের স্থানীয় ভাষা তো আসবেই। 




কাস্টিংয়ে বড় কোনও চমক নেই। অর্জুন, সুপ্রভাতদের সঙ্গে এই নিয়ে বেশ কয়েকটা কাজ করলেন। কোনও তারকা শিল্পী  ছাড়াই কাস্টিং পরিকল্পনা করেছিলেন? 

এটা আমার মতে একটা ব্যাকডেটেড ধারণা। আমি চিরকালই নতুনদের নিয়ে ছবি করেছি, তাঁরা পরে নাম করেছে। আর সিরিজ়ের মূল কথাই হলো চরিত্র হয়ে ওঠা। এটা সিনেমা নয় যে একজন অভিনেতার পার্সোনা কাজ করবে। একটা গল্প, অভিনেতার গ্ল্যামার, আর কিছু গান দিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করে ফেলা যায়। কিন্তু সিরিজ়ে একটা চরিত্রকে নির্মাণ করতে হয়, তার জন্য মানানসই অভিনেতা চাই । ভারতীয় সিরিজ়ে এখন প্রতিদিন নতুন-নতুন নাম উঠে আসছে। এরা হয়তো একেবারেই অচেনা বা হয়তো ছোটখাটো চরিত্রে আগে তাঁদের দেখা গেছে। তাঁরাই সিরিজ়ে এসে এক একটা মনে রাখার মতো চরিত্র সৃষ্টি করছেন। এই পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদেরও পাল্টাতে হবে। চেনা মুখ এখানে কোনও আলাদা মাত্রা যোগ করে না। সে চরিত্র হয়ে উঠছে কিনা সেটাই আসল কথা। অভিনেতাকে দেখে যদি আমার কোনও সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়, তাহলে সে চরিত্র হয়ে উঠবে কী করে? যদি কারোর একটা ইমেজ থাকে যে সবসময় কালো চশমা পরে তাকে আমি সাদা চশমা কীভাবে পরাব? তাই এমন কাউকে চাই যার কোনও ইমেজের ব্যাগেজ নেই। আমার এই সিরিজ়ে যাঁরা রয়েছে তাঁদের এরকম কোনও ইমেজ নেই আর একইসঙ্গে তাঁরা প্রত্যেকে ভালো অভিনেতা। তাঁরা চরিত্র হয়ে উঠেছে, এটাই আমার কাছে বড় কথা। এমনকি অর্জুনও এখন অনেক কাজ করলেও কোনও ইমেজে বাঁধা পড়েনি। বরং ও নানারককম কাজ করছে, এখনও কোন বিশেষ ধরনের চরিত্র দিয়ে ওকে বিচার করা যায় না। অর্জুন, অনিন্দিতা বা সুপ্রভাতের সঙ্গে আমি আগে কাজ করলেও তাঁদের আমি প্রতিটা জায়গায় ভেঙেছি। কোথাও তাঁরা একইরকম চরিত্রে কাজ করেনি। 

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

শেষ প্রশ্ন, আপনার মতে বাংলা ওয়েব সিরিজ়ের ভবিষ্যৎ কী? আর থিয়েটারগুলো কি আবারও আগের মতো দর্শক পাবে?

ওয়েব সিরিজ়ে তো ভালোই কাজ হচ্ছে। আরও ভালো হবে সময়ের সঙ্গে। ওয়েব সিরিজ়ের  পরিচালকরাই বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনবে বলে আমি মনে করি। যাঁরা এই নতুন ধরণের কাজ করছেন, ফিল্মমেকিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁরাই নতুন চিন্তাধারা আনবেন। সিনেমা নিশ্চয়ই আবার ফিরবে। কিন্তু ওয়েব সিরিজ় যে জায়গাটা তৈরি করে নিচ্ছে, যেভাবে প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় সিনেমাকেও ফিরে আসতে গেলে দর্শককে নতুন কিছু দিতে হবে। এমন কিছু তৈরি করতে হবে যা ওয়েব সিরিজ়কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমি বাড়িতে বসেই যেখানে সব পাচ্ছি, সেখানে বেরিয়ে হলে যাব কেন? সেই কারণটা সিনেমাকেও তৈরি করতে হবে তবেই সে আবার আগের জায়গায় ফিরতে পারবে। 



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *