‘বাজে কাজ করতে পারব না, তাই তিনটে দরজাই খুলে রেখেছি’
আপাতত ‘সাহেবের কাটলেট’ বানাতে ব্যস্ত তিনি। এরই মাঝে চলছে মঞ্চে অভিনয় ও গিটার হাতে পুত্র নীল দত্তর সঙ্গে আরও একবার গলা ছেড়ে গান গাওয়ার প্রস্তুতি। আবার ব্যোমকেশের এক নতুন তদন্তেও জড়িয়ে পড়েছেন। গত ২৫ বছর ধরে বাঙালির সবথেকে জনপ্রিয় টেলিফোন নম্বরের স্রষ্টাকে তাই বহুমুখী প্রতিভা বলাই যায়। একই সঙ্গে অন্য পরিচালকের ছবিতেও অভিনয় করছেন অঞ্জন দত্ত। নতুন ছবির চিত্রনাট্য এবং গান বাঁধার ফাঁকে হঠাৎই পাকড়াও করা গেল তাঁকে। রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এল নানান কথা।
আপনার আগামী ছবি ‘সাহেবের কাটলেট’। বলা হচ্ছে এটা কমেডি ছবি। এই ছবির বিষয়বস্তু কি?
‘সাহেবের কাটলেট’ একটা ফুড ফিল্ম। আমার এক বন্ধু সঞ্জিত চৌধুরীর সঙ্গে একবার একটা ফুড ফিল্ম নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখনও আমি জানতাম না ফুড ফিল্ম কাকে বলে। সেই ছবিটা শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে ওঠেনি। তবে সেটা একটা অন্য গল্প। তখন থেকে আমার মাথায় ঘুরত ফুড ফিল্ম করার কথা। বেশ অন্যরকম মজার একটা ছবি হবে। লিখলামও একটা গল্প। সেটা নিয়ে কাজ করব ভাবতে ভাবতেই প্রতীম (দাশগুপ্ত) করে ফেলল ‘মাছের ঝোল’। ওটা ছিল পুরোপুরি ফুড ফিল্ম। আমি পিছিয়ে এলাম। এটা দু’বছর আগের কথা। তখন ‘আমি আসবো ফিরে’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি। তারপর এতদিন পরে এটা নিয়ে কাজ করার কথা মাথায় এল।
কমেডি ছবিই করতে চেয়েছিলেন তাহলে?
আমি এমন একটা ছবি করতে চেয়েছিলাম যেখানে গান থাকবে, মজা থাকবে। ‘সাহেবের কাটলেট’-এ খাওয়াদাওয়া নিয়েও একটা ব্যাপার থাকছেই। একটু ডার্ক ছবি করে থাকলেও, শুরুটা কিন্তু আমি ‘ম্যাডলি বাঙালি’ দিয়েই করেছিলাম। সেটা খুব জমাটি ছবি ছিল। সেই মজাটা আবার ফিরে পেতে চাই। এখন আমি ৬৫, তাই মানুষকে একটু আনন্দও দিতে চাই।
বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
‘ফাইনালি ভালোবাসা’ আপনার অন্যান্য ছবির থেকে আলাদা ছিল। এই ধরণের আর কোনও ছবি ভবিষ্যতে করবেন না?
ওই ছবিটা কয়েকটা সম্পর্কের অন্ধকার দিক নিয়ে করেছিলাম। তবে ওই ধরণের ছবি এক্ষুণি আর নয়। একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি করার কথা ভাবছি। তবে সেটা কিছুদিন পরে করব, ভাবনাচিন্তার পর্যায়ে রয়েছে। ব্যোমকেশ আর করব না, এই সিদ্ধান্তের পর এটা আমার মাথায় আসে।
ক্লিশে হলেও জিজ্ঞাসা করছি, ব্যোমকেশ বন্ধ করলেন কেন? শুরুটা তো আপনিই করেছিলেন, আর ব্যবসার দিক থেকেও সেগুলো সফল ছবি ছিল
এখন তো সবাই ব্যোমকেশ করছে। আমি শুরু করেছিলাম ২০০৮ সালে। কোনও মতে কিছু গল্পের স্বত্ব নিয়ে ২০০৯-এ আবীরকে (চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে শুরু করেছিলাম। আবীর তখন তেমন পরিচিতও নয়। সেটা এত মানুষের ভালো লেগে যাবে ভাবতে পারিনি।
যে জন থাকে মাঝখানে
শেষের দিকে আপনার পরিচালিত ব্যোমকেশের ছবিগুলো দর্শকের ভালো লেগেছিল। ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, আর ব্যোমকেশ নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আপনার ওপর কোনও চাপ এসেছিল কি?
না না, চাপ কেন থাকবে? কিন্তু সকলেই যখন ব্যোমকেশ করছে, তখন আমি আর নতুন কি করতাম? আমার কাছে তো এখনও সেই সব গল্পের স্বত্ব রয়েছে। কিন্তু আবীর, যীশু (সেনগুপ্ত) ব্যোমকেশ করছে অন্যদিকে অনির্বাণ (ভট্টাচার্য) ও সুপ্রভাতের (দাস) জুটিটাও খুব ভালো কাজ করছে। তাই ছেড়ে দিলাম। বরং নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলাম। তবে তার আগে সকলের ভালো লাগার মত একটা ছবি করতে ইচ্ছে হল। আসলে আমাকে আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগেও যদি কেউ বলত এমন একটা ছবি বানাতে হবে যেটা দেখে মানুষ মজা পাবে, নিজের দুঃখ ভুলে যাবে, আমার আপত্তি থাকত। একটা ছবি দেখে জীবনের দুঃখ ভুলে যাওয়া যায় না। কিন্তু আজ, এই বয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে যদি কেউ একটা ছবি দেখে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য তার পারিপার্শ্বিকের সমস্যা ভুলতে চায় তাহলে ক্ষতি কি? সেই কারণেই কমেডি আর রোম্যান্স নিয়ে একটা ছবি ভাবলাম। সেই ছবির অবশ্যই একটা মানে থাকবে, নতুন গান থাকবে।
তাই ‘সাহেবের কাটলেট’?
হ্যাঁ। এই গল্পটা একজন শেফকে নিয়ে। তার জার্নিটা নিয়েই এই ছবি। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে ছবি করতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। বেশ কিছু নতুন গান থাকবে ছবিটায়। অনেকেই বলেন আমি আর নতুন গান করছি না। সেই জন্য এখানে গান নিয়ে আলাদাভাবে ভাবনাচিন্তা করেছি।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
এই গানগুলো নিয়েই কি জুনে আপনার আর নীলের অনুষ্ঠানটা হবে?
না, না। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। ‘সাহেবের কাটলেট’-এর সঙ্গে গানের অনুষ্ঠানটা সম্পর্কযুক্ত নয় কোনওভাবেই। ওখানে পুরনো নতুন মিলিয়ে নানান গান থাকছে। নীলের সঙ্গে করছি অনুষ্ঠানটা, নাম ‘আমি আর গোদো’।
ব্র্যান্ড অঞ্জন দত্তর পরিচিতি তাঁর গান দিয়েই। ছবি করতে গিয়ে সেই গান হারিয়ে ফেললেন কেন? আফসোস হত না?
হারিয়ে ফেলেছি, ঠিক এমনটা নয়। আসলে আমার তখন গান আসছিল না। তাই বহুদিন আমি গান লিখিনি। যেটা ভেতর থেকে আসবে না, সেটা করব কেন? ভালো গান আর লিখতে পারছিলাম না। এখন আবার নতুন করে গান আসছে, কথা আসছে। মজার গান, আনন্দের গান, খাওদাওয়ার গান, এইসব নিয়েই পাঁচটা গান থাকছে এই ছবিতে যার মধ্যে কিছু আমি লিখেছি, নীল সুর করেছে।
‘সাহেবের কাটলেট’-এ খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটা ব্যাপার থাকছে সেটা বুঝলাম। কিন্তু ফুড ফিল্ম মানেই কি শেফের গল্প হতে হবে?
না, তা নয়। এই গল্পটা একজন শেফের। তার জন্ম এখানেই কোনও এক শহরতলীতে, বড় হয়ে ওঠা মুম্বইতে। ব্যাঙ্গালোর থেকে পাশ করেছে, গোয়াতে কাজ করেছে কিছুদিন। এই ছেলেটি ইউরোপিয়ন খাবার খুব ভালো বানাতে পারে, কিন্তু কোথাও বেশিদিন টেকে না, কেননা খাবার নিয়ে কোনওরকম আপোষ করতে সে নারাজ। ওর জীবনের স্বপ্ন হল ইউরোপে গিয়ে কাজ করা। এ দেশে কাজ করতে তার আর ভালো লাগে না। সেটা সাত তারা হোটেল হলেও ভাল লাগছে না। এই ছেলেটির যে জার্নিটা, সেটা খুব মজার। এইভাবে নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সে একসময় বোঝে যে যদি একটা শিঙাড়াও ঠিকঠাক বানানো যায়, সেটার জন্যেও যথেষ্ট ক্ষমতা লাগে। নিজের দেশের মানুষের রুচিকে তৃপ্ত করেও তো তৃপ্তিলাভ করা যায়। এই সব মিলিয়েই একটা সুন্দর সেলিব্রেশনের গল্প থাকছে ‘সাহেবের কাটলেট’–এ।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
‘অপারেশন রাইটার্স’ কি একেবারেই বন্ধ?
না, বন্ধ নয়। তবে এখন করছি না ওটা। শ্রীকান্ত (মোহতা) ফিরুক, তারপর দেখা যাবে।
আপনার সব ছবিতেই শহুরে ছাপ স্পষ্ট। সেভাবে গ্রাম বাংলার গল্প বা মফঃস্বলের গল্প আপনি কখনওই বলেননি। এটা কেন?
আমাকে এটাই টানে। এমন কি ‘অপারেশন রাইটার্স’ও তো শহুরে গল্প। তিনটে আঠারো-উনিশের বাচ্চা ছেলে পায়ে হেঁটে রাইটার্সে ঢুকে গুলি করে এল। এটা কোনও গ্রাম্য ব্যাপার হতে পারে? যেমন ‘পদ্মানদীর মাঝি’, অসাধারণ একটা উপন্যাস। কিন্তু ওটা আমাকে টানে না। কারণ ওটা আমি জানি না। আমি যেটা জানি, যেটার সঙ্গে পরিচিত সেটাই করব। যেটা জানিনা, সেটা আমার করা উচিত নয়। আমি জীবনেও কোন সিরিয়াল কিলার দেখিনি। তাহলে সিরিয়াল কিলার নিয়ে ছবি করব কিভাবে ? শুধু হলিউডে আর নেটফ্লিক্সে হচ্ছে বলেই করতে হবে? ও আমার দ্বারা হবে না। আমি যেটা জানি তার বাইরে আমি কখনওই যাব না। যেমন মৃণাল সেন কোনওদিন মিউজ়িকাল করেননি, সত্যজিৎ রায় করেছেন। কারণ উনি ব্যাপারটা বুঝতেন। যেটা যার জায়গা।
জোর করে সবাই সবকিছু করছে বলছেন?
আসলে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলোও খুব সেকেলে রয়ে গেছে। ধুতি পড়লেই নাকি তিনি আরবান নন, এরকম একটা ধারণা আছে। অশিক্ষিত প্রচুর লোক গিটার নিয়ে গান গাইছে, তারা নাকি আরবান। আমার দাদু ধুতি শার্ট পড়ে বিদেশী গান শুনতেন, পরিষ্কার ইংরেজি বলতেন। শহুরে ব্যাপারটা তো মাথায় থাকে। আরবান মানেই পার্ক ষ্ট্রীট, গিটার নিয়ে গান, কালো চশমা, দার্জিলিং আর অঞ্জন দত্ত, কেন ? দার্জিলিঙে প্রচুর গ্রাম্য গরীব মানুষ আছেন। মধ্যমেধার যুগে সমস্ত ধারণাগুলোই বোকামিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আসল কথা হল চিন্তাভাবনায় কে কতটা আধুনিক। সারাজীবন গ্রামে থেকেও একটা লোক চিন্তাভাবনায় আধুনিক হতে পারে, কথাবার্তায় শহুরে হতে পারে।
সত্যজিৎ ও রেলভূত
অভিনেতা হিসেবে মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেনের সঙ্গে কাজ করেছেন, আর এখন করছেন প্রতিম, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম শীলদের সঙ্গে। এই দুই প্রজন্মের মধ্যে কাজের ধরণে কি তফাত দেখছেন?
দেখো, একজন অভিনেতা হিসেবে আমি মৃণাল সেনকে যা দিয়েছি, অপর্ণা সেনকে যা দিয়েছি, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে যা দিয়েছি প্রতিমকে বা সৃজিতকেও তাই দেব। তখন আমাকে এত লোকে হয়ত কাজ দিত না, এখন দিচ্ছে। আমি ওই চরিত্রগুলোর জন্যেও যতটা খেটেছি, এগুলোর জন্যেও ততটাই খাটছি। তফাত বলতে ক্ষমতার একটা তফাত তো থাকবেই। ধরো, মৃণাল সেন যেভাবে একটা চরিত্র নিয়ে ভাবতেন বা যেভাবে আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতেন, সেটা তো আর কেউ পারবে না। তবে পরিচালক আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেবেন, আমি সেভাবেই কাজ করব। আমি সব কাজের ক্ষেত্রেই আমার সেরাটা দিয়ে থাকি। তবে বেছে কাজ করা পছন্দ করি আমি। আজ যদি নতুন কেউ মৃণাল সেনের মতো প্রতিভা নিয়ে আসে, তার বয়স যদি কমও হয় তাহলেও আমি তার সঙ্গে কাজ করতে রাজি। আমি কৌশিক সেনের পরিচালনায় থিয়েটার করেছি, কেননা আমার মনে হয় আমি যদি সৃজিতের সঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে কৌশিকের সঙ্গেও থিয়েটারটাও আমার করা উচিত। নাটক আমার খুব পছন্দের জায়গা। আমি এই কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই। নতুন কাজ করতে চাই। প্রত্যেকেই তার নিজের জায়গায় অভিনব কিছু করছেন, তাই এখানে কোনও তুলনা চলতেই পারে না।
এই যে বললেন বেছে কাজ করেন, সেটা কি সব পরিচালকের ক্ষেত্রেই?
আমি যদি বুঝি যে এই চরিত্রটা আমি করতে পারব, তবেই রাজি হই। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে অনেকের চিত্রনাট্য ফিরিয়ে দিতে হয়। আমি সকলের সঙ্গে কাজ করি না। আমি একটা স্ট্যান্ডার্ড-এ বিশ্বাসী। বাজে কাজ আমি করতে পারব না। যখন গান করতাম, আমাকে বলা হয়েছিল মাচায় গান করতে। সেটা করব না বলেই আমি অভিনয়ের জগতে চলে এলাম। আমাকে বাজে ছবিতে অভিনয় করতে বলা হলে আমি পরিচালনায় চলে গেছি। আবার বাজে ছবি পরিচালনা করতে বললে আমি গানে চলে যাব। আমি এই তিনটে জায়গায় ঘুরপাক খাই, কারণ আমার স্ট্যান্ডার্ড এর সঙ্গে আমি আপোষ করব না। এটা আমার দর্শন বলতে পারো। আজ যদি আমাকে শুধু গান করে খেতে হত, তাহলে হয়ত মাচায় উঠে গাইতেই হত। আমি তিনটে দরজাই খুলে রেখেছি যাতে কাজটা আনন্দ করে করতে পারি। আগে যে সময়ে কাজ করেছি সে সময় মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি বলতে যা বোঝাত, এখন কিন্তু তা আর নেই। মেইনস্ট্রিমে এখন অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। হয়ত ওয়ার্ল্ড সিনেমার থেকে আমরা তিরিশ বছর পিছিয়ে আছি। তবু সত্তর বছর তো পিছিয়ে নেই। ভালো কাজ হচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি। এটা একটা ভালো খবর।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
অভিনয় না পরিচালনা, আপনার নিজের পছন্দ কোনটা?
আমি তো বরাবর অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম। আমি গানও করতে চাইনি, পরিচালনাতেও আসতে চাইনি। অভিনেতা হতে পারিনি বলেই গান গাইতাম এক সময়। তবে আমার মনে হয় আমি পরিচালক হিসেবে যে ছবিগুলো করি তার সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কারণ আমি আশির দশকে যে ধরণের অভিনয় করতে চেয়েছি সেটা সেই সময়ে খুব কম মানুষ বুঝতেন। আবার আমি এই মুহূর্তে যে ধরণের ছবি করছি সেটাও অনেকে বুঝতে পারছে না। বাঙালির কাছে এখনও নস্ট্যালজিয়ার মূল্য অনেক বেশি। যে বক্তব্যগুলো আমি ছবির মাধ্যমে বোঝাতে চাইছি, সেটা কেউ ধরতে পারছে না। আমার নিজের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা পরিচালনা। এমন কোনও পরিচালক নেই যে আমাকে একটা চরিত্র দিয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। আমি চাই কেউ করুক, যেটা নিয়ে আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে কাটাতে হবে, নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমার ছবিগুলোয় যেমন গুছিয়ে গল্প বলার আমার কোনও দায় নেই। ছবির সঙ্গে একাত্ম না হলে বোঝা সম্ভব নয়। সেই জন্য দর্শককে পরিণত হতে হবে। আমার ‘ম্যাডলি বাঙালি’তেও এই ব্যাপারটা ছিল, ‘ফাইনালি ভালোবাসা’তেও ছিল। সিনেমার এই ভাষাটা বোঝার দর্শক চাই। সবসময় একটা ঘরের ভেতরে তিনটে চরিত্র কথা বলছে, এভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে কেন? সারা বিশ্বে সিনেমার ভাষা বদলে গেছে। বাংলা গানের ভাষাকে কবীর সুমনই কত এগিয়ে দিয়েছেন। আমরা তার পরের প্রজন্ম হয়ে কি করছি? দর্শককে পরিণত করতে হবে আমাদেরকেই। আমাকে তো কেউ বলেনি বেলা বোস লিখতে। একটা ফোন নম্বর নিয়ে একটা গান হতে পারে কেউ কোনওদিন ভেবেছিল? আমি করলাম, লোকে অনেকরকম কথা বলেছিল। তারপর সেটা জনপ্রিয়ও হল।
তার মানে দর্শককে নতুন কিছু দিতে হবে?
অবশ্যই। কথায় কথায় শুধু পুরনো উদাহরণ টেনে এনে তো লাভ নেই। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক ঘটক যা করে গেছেন তা আর কেউ করতে পারবেন না নিশ্চয়ই। তাই বলে সেটা ধরে বসে থাকলে তো চলবে না। আমরা কেউ সত্যজিৎ বা মৃণাল হতে পারব না, কিন্তু নিজের মত করে কাজটা তো করতে পারি। আমি রবীন্দ্রনাথ নই, কিন্তু তাঁকে আমি আমার মত করে বুঝি। আমি সত্যজিৎ ও মৃণালের মত করে কাজ করব কেন? আমি তো আমার মত করে করব। জাপানে কুরোসাওয়াকে কি মানুষ পুজো করে? আমার জানা নেই। আজ যদি জনি টো’র একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, সেখানে কি কুরোসাওয়াকে নিয়েই সারাক্ষণ কথা হবে? অথচ এখানে সেটা হয়। আমরা সারাক্ষণ বার্ধক্যে ভুগি। কি ছিল আর কত ভাল ছিল। নতুন কিছুকে গ্রহণ করার মানসিকতা তো থাকতে হবে। তবে বাংলা ছবি আগের থেকে কিছুটা সাবালক হয়েছে নিশ্চয়ই। যেখানে গোলাপী প্যান্ট পরা বন্ধ হয়েছে, দক্ষিণের ছবি থেকে রিমেক বন্ধ হয়েছে, গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বা নেচে নেচে গান গাওয়া বন্ধ হয়েছে। তবে ছবি মানেই একটা গোছানো গল্প থাকতে হবে এই ধারণাটা থেকে এখনও বাঙালি বেরোতে পারেনি। অগোছালোভাবে গল্প বলাটা কিন্তু আরও শক্ত। এভাবেই সারা বিশ্বে ছবি হচ্ছে। এখানে মজার ছবি মানেই লোকে ধরে নেয় সে ছবিতে মজা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। কিন্তু ‘সাহেবের কাটলেট’ মজার ছবি হওয়া সত্বেও আরও অনেক কিছু থাকছে। মজার ছবিতেও অন্যভাবে মেসেজ দেওয়া যায়।
নাটকের প্রসঙ্গে আসি। ‘সেলসম্যানের সংসার’ করছেন আপনি। আর্থার মিলারের মূল নাটকটা থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন করেছেন এখানে। সেটা কি এই সময়ের কথা মাথায় রেখে?
কিছুটা কেটেছেঁটে কমাতে হয়েছে সময়ের জন্য। কিন্তু সেই ১৯৪০-এ আমেরিকার যা অবস্থা ছিল, আমাদের তো এখন সেই অবস্থা। মধ্যবিত্ত সেই টাকার পিছনে দৌড়চ্ছে, অথচ কোনওদিন বড়লোক হতে পারেছে না। নাটকটা এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এডিটটা মূলত সময়ের কারণেই করতে হয়েছে আমাকে। নাহলে অনেকটা বড় হয়ে যেত।
আপনার পরের ছবিটা তো পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। এই ছবিটা নিয়ে কি কিছু বলা যাবে?
সেটা ওকে জিজ্ঞাসা না করে বলা উচিত হবে না। তবে পরমকে আমিই সিনেমার জগতে নিয়ে এসেছিলাম। পরম খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তাই ও কোনও কাজ করলে, সেখানে যদি ও আমাকে চায়, আমার মনে হয় সেটা করা উচিত। এটুকু বলতে পারি এটা একেবারে অন্য ধরণের একটা ছবি হবে। বাংলা ছবিতে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি। আমার নিজের খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে ছবির বিষয়টা। আমার এটাই ভালো লাগে যে ও নানান রকমের কাজ করছে। অভিনয়ের সঙ্গে পরিচালনার কাজটাও খুব মন দিয়ে করছে। কিছু বাজে সিরিয়াল করে সময় নষ্ট না করে অন্তত নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। এটার প্রশংসা করি আমি। আমার এটা ভাবতেই এখন ভালো লাগে যে যাদের শুরুর সময়ে আমি ছিলাম যেমন আবীর, পরম, পার্নো (মিত্র), ঋত্বিক (চত্রবর্তী), সুপ্রভাত, এদের শুরু থেকে আমি দেখছি। এরা ভালো কাজ করলে আমার ভালো লাগে। আমার সমসাময়িক পরিচালকরাও এখন এত রকম নতুন চিন্তাভাবনা করছেন, নানান রকম বিষয় নিয়ে ছবি করছেন, সে কৌশিক গাঙ্গুলি হোক, কি সৃজিত অরিন্দমরাই হোক। এই ব্যাপারগুলো প্রশংসনীয় যে কিছু তো কাজ হচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে, অন্তত এগোবার চেষ্টা তো করছি আমরা। সকলেই প্রতিদিন ভাবছি নতুন করে আরও ভালো ছবি কি করে দর্শককে উপহার দেওয়া যায়। সব মিলিয়ে এই চেষ্টাটা আমার মনে হয় বাংলা ছবিকে আগামী দিনে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ছবি: আমারা মিউজ়িক