দু’ধরণের ছবিই প্রয়োজন, মত প্রসেনজিৎ, ঋতাভরীদের
কলকাতা: কাল্পনিক ছবি নাকি বাস্তবধর্মী? দর্শক কোনটা দেখতে চান? দু’ধরণের ছবির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চিরকালের। সেই চিরকালীন বিতর্কের বিষয়কেই উস্কে দিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গতকালের সিনে আড্ডা। প্রতিবছর মূল প্রেক্ষাগৃহের বাইরে একতারা মঞ্চে নানারকম আলোচনা ও বিতর্কের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চের এই অনুষ্ঠান খোলা থাকে সর্বসাধারণের জন্য। তবে সিনে আড্ডার বিষয় নয়, বরং বিতর্কে অংশ নিতে আসা তারকারাই ছিলেন দর্শকের আগ্রহের মূল কারণ। ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়, ঋতাভরী চক্রবর্তী ও জিতু কমল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রাজ চক্রবর্তী।
বিতর্কের অবকাশ থাকলেও শুরু থেকেই বিষয়টিকে আলোচনার স্তরে নামিয়ে আনলেন প্রসেনজিৎ। তাঁর মতে কাল্পনিক হোক বা বাস্তবধর্মী, আসলে ছবি মানেই সেখানে কিছু কল্পনা লুকিয়ে থাকে। “আগে যেমন আর্ট ফিল্ম বলা হতো পরে সেটাই হলো প্যারালাল ছবি। এখন সেটার আঙ্গিকও অনেক পাল্টে গেছে। আমার কাছে ছবি মানে স্রেফ ভালো ছবি আর খারাপ ছবি। যদি বলা হয় আর্ট ছবি ব্যবসা করে না তাহলে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবির সাফল্যকে কী বলব? আমি যদি ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ না করতাম তাহলে কিন্তু ‘উৎসব’ ছবিটাও করতে পারতাম না। যারা আমাকে প্রসেনজিৎ বানিয়েছেন, তারা ওই ছবিগুলো দেখেই আমাকে আজকের এই জায়গাটা দিয়েছেন। সেই কারণেই আজ আমি আমার পছন্দের ছবি করতে পারি।’ ঋতুপর্ণ ঘোষ বলতেন, স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তীরা যদি কমার্শিয়াল হিট না দিতেন তাহলে প্রযোজকরা তাঁর মতো পরিচালককে এইসব ছবি বানাবার সুযোগ দিত না, মনে করিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ।
আরও পড়ুন: ডেভিড হেয়ারের জীবনী প্রকাশ
ঋতাভরীর মতে, “সব ধরণের ছবি হওয়াই দরকার। প্রতিদিন তো ডাল-ভাত খেতে ভালো লাগে না। এক একদিন অস্বাস্থ্যকর জেনেও তো আমরা পিৎজ়া খাই। কেন আমাকে রোজ এক খাবার খেতে হবে? তাই সবরকম ছবি হওয়া উচিত যেটা মানুষ দেখবেন, দেখে তারাই বেছে নেবেন।” তবে মানুষ যেটা চাইছে সেই ধরনের ছবি করার যেমন দরকার তেমনই মনের খিদে মেটাতে শৈল্পিক ছবি করাটাও একজন শিল্পীর প্রয়োজন। সেটাও অবশ্যই করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
আবিরের মতে দর্শককেই ঠিক করতে দেওয়া হোক তারা কী চাইছেন। “নতুন প্রজন্ম আমাদের কাছে কী চাইছে সেটাও জানা দরকার। ওরা যে ধরণের ছবি দেখতে চায় সেটাই বানানো উচিত। কারণ নতুন প্রজন্ম অনেক তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারাই ঠিক করুক আমরা কী বানাব,” মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: মেওয়ারি ভাষার ছবি বিদ্যুৎ এনে দেবে প্রত্যন্ত গ্রামে
“আমাকে আসলে ঝোলে ঝালে অম্বলে সবরকম চরিত্রই করতে হয়,” বললেন খরাজ। “কিন্তু কথা হচ্ছে, আমি থাকি বা ঋতাভরী কিংবা জিতু থাকুক, যেই থাকুক আমরা ক’জন থাকলে কি এখানে এত মানুষ আসতেন? এদের আসার কারণ কিন্তু বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ) আর আবির।” প্রসেনজিৎ যেভাবে ‘অমর সঙ্গী’ ছবিতে সাদা পোশাকে গান গেয়ে দর্শককে মুগ্ধ করেছিলেন, সেই দর্শকই চাইছেন প্রসেনজিৎ এখন বাস্তবধর্মী চরিত্র করুন। না হলে মানুষ ‘২২শে শ্রাবণ’ দেখতে আসত না, মনে করেন খরাজ।
পরিচালক হিসেবে রাজ মনে করেন কল্পনা নিয়ে ছবি হলে যদি হলে সিটি পড়ে তেমনই বাস্তবিক কাহিনিতে ছবি হলে দর্শক হলে বসে ধৈর্য নিয়ে ছবিটা দেখেন। কাজেই দুই তরফেই দর্শক আছে বলে মনে করেন তিনি।
জিতু তাঁর নিজের পরিবারকে ফিল্মি বলে বর্ণনা করলেন। অভিনেতা হিসেবে নয়, দর্শক হিসেবেই তিনি জানালেন, “‘অপরাজিত’ করার সময় আমি সত্যজিৎ রায়ের নানা ক্লিপ দেখে দেখে শিখেছি তিনি কীভাবে কথা বলতেন, কীভাবে হাঁটতেন বা কীভাবে চিন্তা করতেন। এটা তো বাস্তব। কিন্তু সেটে গিয়ে তো আমাকে কল্পনার আশ্রয় নিতেই হলো। আমি তো জানি না তিনি রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কী করতেন? হতাশায় বা দুঃখে তিনি কাঁদতেন কি? এগুলো তো কল্পনা করে নিতে হচ্ছে।”
তবে সকলেই এই ব্যাপারে একমত হন যে দু’ধরণের ছবিই প্রয়োজন। তাতে যেমন বিভিন্ন ধরণের দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছনো, যাবে তেমনই নিজেদের শিল্পীসত্বার কাছেও সৎ থাকা সম্ভব হবে।
ছবি: সুফল ভট্টাচার্য