বাস্তবের আয়নায় সমাজের প্রতিফলন
ছবি: সাক্ষী
নির্দেশনা: সৌভিক সরকার
অভিনয়ে: সায়নী ঘোষ, অর্জুন চক্রবর্তী, দেবশংকর হালদার, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, ঋ, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২ মিনিট
RBN রেটিং : ৩/৫
শহরের কুখ্যাত মাফিয়া ও ব্যবসায়ী ভাইদার (দেবশংকর) প্রশ্রয়ে তার আপন ভাই জগতের (অনিন্দ্য) প্রবল বাড়বাড়ন্ত। সে যাই অপরাধ করুক তার দাদা তাকে বাঁচিয়ে দেয়। যদিও সেই দাদাকেও যে সে খুব ভক্তি করে তেমন নয়। তবু দাদার ডানহাত বরুণদা (শান্তিলাল) তাকে চোখে চোখে রাখে ও প্রয়োজনে তার কুকীর্তির সমর্থনে মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। কয়েকবার পরপর এই মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার কাজ সুন্দরভাবে উৎরে দেয় শ্যামল (অর্জুন)। ফলে সে অচিরেই ভাইদার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে।
বাবা ও ছোট বোনকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে কাজ খুঁজতে আসে শিখা (সায়নী)। কিন্তু প্রথম দিনেই ঝড়বৃষ্টির রাতে সে জগতের নজরে পড়ে। জগৎ তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে শিখাকে ধর্ষণ করে। যথারীতি শ্যামল মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে থানা থেকেই জগৎকে ছাড়িয়ে আনে। সমাজকর্মী মঞ্জুলা (লকেট) শিখার সহায় হলেও তার গায়ে দেহোপজীবিনীর তকমা লেগে যায় এই ঘটনার পর। শিখাকে রাস্তাঘাটে দেখতে পেলেই জগৎ ও অন্য সমাজবিরোধীরা শেয়াল কুকুরের মত ছিঁড়ে খেতে চায়। শিখার অসহায়তা দেখে শ্যামল নিজের ভুল বোঝে ও ক্রমশ মানবিকতাবোধে শিখার প্রতি আকৃষ্ট হয়। যদিও শিখা তাকে খুব সহজে ক্ষমা করতে পারে না। মঞ্জুলার সহায়তায় শিখা ও শ্যামল ক্রমশ জীবনের মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শিখাকে নিয়ে জগত ও শ্যামলের মধ্যে বার বার সংঘাত লাগে।
যে জন থাকে মাঝখানে
এই সময় একদিন শিখাকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে উদ্ধার করে নতুন বদলি হয়ে আসা পুলিশের বড়বাবু জুনেইদ। কর্তব্যপরায়ণ এই পুলিশ অফিসারের সংস্পর্শে এসে শিখা বোঝে তারও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে, সেও সন্মান পাবার যোগ্য। ধীরে ধীরে তার চোখের ওপর থেকে একটা পর্দা সরে যায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। আবারও শিখা ও শ্যামল নতুন করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। ঘটনা আবারও আদালত অবধি গড়ায়।
প্রায় দু’বছর ক্যানবন্দী হয়ে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পেল সৌভিকের ‘সাক্ষী’। দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে শুধু টাকা ছড়িয়ে সাক্ষী কেনাবেচা করে যেন-তেন-প্রকারেণ মামলা জেতা আজকের দিনে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সমাজের সর্বস্তরেই এটা এখন একপ্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’ বলা চলে। সেই নীতিকে কাজে লাগিয়ে ভাইদার মতো অতীব শক্তিধর মাফিয়ারা পার পেয়ে যান বারে বারে।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
সমাজের এই বাস্তব চিত্রকে কোথাও অস্বীকার করে না এই ছবি। কোনও দিনবদলের স্বপ্নও দেখায় না। বরং কঠোর কঠিন বাস্তবের আয়নায় দর্শককে দাঁড় করিয়ে দেয় অবলীলায়। প্রথমবার পরিচালনায় এসে এমন জটিল গল্প নিয়ে কাজ করার সাহস দেখানো অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কাহিনী ও চিত্রনাট্যও পরিচালকের। জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের চিত্রগ্রহণ যথাযথ। নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কিছু গান শুনতে ভালো লাগে। জাভেদ আলী ও মোহলিমার কণ্ঠে ‘রেহনুমা’ গানটি বেশ শ্রুতিমধুর।
অভিনয়ের কথায় আসা যাক। বরাবরের মতই এবারও অর্জুন তার অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন। যে কোনও ধরণের অভিব্যক্তিতে মুখের মাংসপেশির স্বাভাবিক ওঠাপড়া দিয়ে দর্শককে আসনের সঙ্গে গেঁথে রাখতে সক্ষম তিনি। সায়নী ভালো অভিনেত্রী, তার সোজাসাপটা অভিনয় মনে দাগ কাটে। দেবশংকরের মত শক্তিশালী অভিনেতার এই ছবিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না। ভাইদার চরিত্রে কিছু বিশেষ ম্যানারিজ়ম যোগ করা ছাড়া আর কোনও অভিনয়ের সুযোগ পাননি তিনি। একই কথা খাটে শান্তিলালের ক্ষেত্রেও। বরুণদার চরিত্রে নির্লিপ্ত অভিনয় ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। অনিন্দ্য নিজের প্রতি এতটাই সুবিচার করেছেন যে জগতের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কোনও অভিব্যক্তি আসে না। তবে তার মত স্বাভাবিক অভিনেতার আরও অন্য ধরণের চরিত্রে কাজ করা উচিত। মোটামুটি একই ধরণের চরিত্রে তাকে বারবার দেখা যায়। ঝিল্লির চরিত্রে ঋ যথেষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত। এই ধরণের চরিত্রে বরাবরই মানিয়ে যান তিনি। একজন যৌনকর্মী হয়েও ঝিল্লির চরিত্রে যে আত্মসম্মানবোধ দেখানো হয়েছে, তা সমাজের নীচুতলার কর্মীদের জন্য আশা জাগায়। লকেট তার চরিত্রে যথাযথ। খুব বেশি সুযোগ তিনিও পাননি।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
সবশেষে বলতে হয় জুনেইদ চরিত্রটির কথা। এই চরিত্রের অভিনেতার হাঁটাচলা কথাবার্তা সবই অত্যন্ত নায়ক সুলভ লেগেছে, যা চরিত্রের সঙ্গে মানিয়েও গেছে। এই অভিনেতাকে টালিগঞ্জ যদি কাজে লাগাতে পারে তাহলে তিনি হয়ত সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন বাংলা ছবির। ছোট একটি চরিত্রে পার্থসারথি দেব সু-অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেলেন।
কিছু ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারলে আরও মেদহীন হতে পারত এই ছবি। শিখা গ্রাম থেকে আসা মেয়ে হলেও তার বাবার কথাবার্তায় যে গ্রাম্য টান দেখা যায় তা শিখার মধ্যে অনুপস্থিত। তার হাঁটাচলা ও শরীরী ভাষাও বেশ শহুরে। ভাইদার চরিত্রের নিষ্ঠুরতা বোঝাতে শুধুমাত্র কিছু ম্যানারিজ়মের ব্যবহার যথেষ্ট ছিল না। চরিত্রটি নব্বইয়ের দশকের ভিলেনদের মত একরঙা লেগেছে। দেবশংঙ্করের মত একজন তুখোড় অভিনেতার উপস্থিতিতে চরিত্রটিকে আর একটু সুযোগ দেয়া যেতে পারত। এছাড়া শুধুমাত্র নারীঘটিত ঘটনা ছাড়া ভাইদার কার্যকলাপের আরও একটা বিবরণ পাওয়া গেলে চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। এছাড়া জুনেইদের চরিত্রটি আসার পরে গল্পের গতি বেশ শিথিল হয়ে যায়। একের পর এক গানের ব্যবহারও সেই সময় গল্পকে এগোতে বাধা দেয়। তবে এরকম কিছু ছোটখাটো খুঁত বাদ দিলে সমাজের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে এই ছবি।