এক উপরি পাওনা, তারপর নিকষ কালো অন্ধকার
যখন ছোট ছিলাম, সমস্ত দুপুরটা জুড়ে আমি ঠাম্মাকে দেখতাম আমাদেরই পাড়ার এক ‘সই ঠাম্মা’কে সঙ্গে নিয়ে পুরনো শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে কাঁথার উপর একটার পর একটা ফুল বুনছে। সংসারের সমস্ত কাজ সেরে বিশ্রাম নেবার একান্ত নিজস্ব সময়টুকু সুখদুঃখের গল্প করতে করতে প্রয়োজনীয় শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়েই এভাবে কাজে লাগাত ঠাম্মারা। ছোটবেলায় দেখা ঠাম্মাদের দুপুরের এই কয়েক ঘন্টা সময় কেন জানিনা এক মোহময় মায়াবী জগতের মতো আজও আমাকে আকর্ষণ করে।
কিছুদিন আগে ঘুরে আসা পেনসিলভেনিয়ার পাহাড়ি উপত্যকায় অ্যামিশদের ছোট্ট শান্ত গ্রামটি আবার আমার ছোটবেলার জগতের কথাই মনে করিয়ে দিল। প্রায় মাস চারেক প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সাদাকালো সময়পর্ব কাটানোর পর, নববসন্তের ঝকঝকে রোদ্দুর আর উপত্যকাজুড়ে কচি নরম সবুজ ঘাসের উপরে হলদে রঙের বুনো ফুলের শোভাকে নরম গালিচা নয়, বরং ঠাম্মার বোনা কাঁথার সঙ্গে উপমিত করার লোভটুকু ঠিক সামলাতে পারলাম না। যাত্রাপথের মূল উদ্দেশ্য ছিল গা ছমছমে রোমাঞ্চকর পরিবেশের পেন্স কেভ (Penn’s Cave)। সেখানে অ্যামিশ ভিলেজ কিছুটা উপরি পাওনা হিসেবেই জুটে গিয়েছিল। মূলত দক্ষিণ–পূর্ব এবং দক্ষিণ-মধ্য পেনসিলভেনিয়ার একটি অংশ জুড়েই অ্যামিশদের গ্রাম।
অ্যামিশদের উপত্যকার উপর দিয়ে সবুজ মাঠের বুক চিড়ে মসৃণ কিন্তু ঢেউ খেলানো পাকা রাস্তাটা সোজা চলে গেছে দূরে, যেখানে মাটি আর আকাশের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটা গুনগুন করতে করতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছিল পেন্স কেভের দিকে ওই রাস্তাটা ধরেই। পথ পেরোতে পেরোতে চারিদিকের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল কোনও এক দক্ষ উপস্থাপক পাওয়ারপয়েন্টে একটার পর একটা স্লাইড দেখিয়ে আমাদের মোহিত করে দিচ্ছে।
সবুজে ঘেরা অ্যামিশদের কটেজ
তবে এই স্লাইড শো–এর কাহিনী শুরু করার আগে একটু ফেলুগিরি করে নিলে কেমন হয়?
আরে না না, ফেলুগিরি মানে কোনও জটিল রহস্য সমাধান করে ফেলার মতো গোয়েন্দাগিরি করার কথা বলছি না। ওই যে, ফেলুদা বলে না, ‘কতগুলো তথ্য জানা থাকলে দেখতে আরও ভালো লাগবে,’ সেরকম আর কি। যদিও আজকের দিনে গুগ্লের মতো্ সিধুজ্যাঠা থাকতে এই প্রসঙ্গটার উল্লেখ অনাবশ্যক, তবু অ্যামিশদের কথা বলতে শুরু যখন করেইছি, তখন ওদের ইতিহাস আর জীবনযাপন সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নেওয়া যাক।
১৬৯৩ সালে সুইটজ়ারল্যান্ডে অ্যানাব্যাপটিস্টদের মধ্য থেকে, জ্যাকব অ্যামানের নেতৃত্বে একটি দল পৃথক হয়ে গিয়ে অতি সাধারণ এক জীবনযাপন শুরু করে। এরাই ক্রমে পরিচিত হয় অ্যামিশ নামে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে যখন বহু মানুষ আমেরিকায় আসতে শুরু করেন, তখন অ্যামিশরাও এদেশে এসে তৎকালীন ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত আমেরিকান রাজ্য পেনসিলভানিয়ায় (যার ট্যাগলাইন Pursue the Happiness) বসবাস শুরু করে। খ্রীষ্টানধর্মে বিশ্বাসী হলেও, অন্যান্য প্রোটেস্টান্টদের থেকে কয়েকটি বিশ্বাসের জন্য এদের ধর্মবিশ্বাস আলাদা। এরা মনে করে ভগবানের ওপর বিশ্বাসই মুক্তির একমাত্র পথ নয়। বরং এই নিশ্চয়তার কথাটা ভাবাটাই অহংকার। এদের ধর্মীয় আচারের কোনও লিখিত রূপ নেই। দৈনন্দিন জীবনযত্রার মধ্য দিয়েই এরা ধর্মীয় আচার রপ্ত করে। বাইরের জগতের পাপ ও দূষণ থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখার জন্য এরা কোনও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে না।
অ্যামিশদের উপত্যকায় ঢুকেই প্রথম যে স্লাইডটি চোখ জুড়িয়ে দেয় তা হলো পাহাড় দিয়ে ঘেরা আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। এই মাঠের মধ্যেই আছে কটেজ টাইপের ছোট-ছোট ঘরবাড়ি। কোনও কোনও বাড়ির উঠোনে দেখা যায় বাচ্চারা মনের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে। কোনও বাড়িতে আবার দেখা যায় অ্যামিশ রমণী গৃহকর্মে ব্যস্ত।
সমস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বৈদ্যুতিক ওয়াশার এবং ড্রায়ার ব্যবহার করে জামাকাপড় কাচা এবং শুকনোর জন্য, তখন অ্যামিশদের গ্রামে দেখা যায় জামাকাপড় মেলা আছে উঠোনে। এদের পোশাক-আশাকেও খুব একটা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে না। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে এরা সাধারণত সাদা–কালো পোশাকই পড়ে। তাই একটু অবাক তো হতেই হয় এদের জীবনযাত্রা দেখে।
চাষে ব্যস্ত স্থানীয় কৃষক
তবে অবাক হবার আরও কিছু বাকি থেকে যায় যখন দেখা যায় ঘোড়ার সাহায্যে লাঙ্গল টেনে চাষ করছে কোনও অ্যামিশ কৃষক, বা দেখা যায় সন্তান-সন্ততিসহ কোনও একটি পরিবার পড়ন্ত বিকেলেও মহানন্দে চাষ করে চলেছে। সব থেকে মজা লাগে বাছুর রাখার জন্য ছোটো-ছোটো সাদা তাঁবুর সারিবাঁধা ঘরগুলো দেখতে। সাধারণত চাষবাস এবং ডেয়ারি শিল্পই এদের জীবিকা । তাই বড় বড় গোশালাও দেখতে পাওয়া যায় এই গ্রামে।
শৈশবটা গ্রামে কাটানোর সুবাদে গরুর গাড়ি অনেক চড়েছি। এমনকি বড় হয়ে ঘোড়ার গাড়িও চড়েছি কখনও কখনও। বলা বাহুল্য সেগুলো ছিল নিতান্তই শখে। কিন্ত শহুরে শৌখিনতার উপাদানই যে এদের কাছে আজও প্রয়োজনীয় সামগ্রী হয়ে আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন দেখলাম নিত্যব্যবহার্য জিনিস নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলেছে বাড়ির পথে। এমনকি বাড়ির লেটারবক্সগুলো ঘোড়ার গাড়ির স্টাইলে, নিদেনপক্ষে সেই বাক্সে ঘোড়ার গাড়ির চাকার মূর্তি রয়েছে।
স্বভাবতই ভ্রমণবিলাসী বাঙালি মনটা আমার বেশ তৃপ্ত হয়েছিল অ্যামিশ ভিলেজের অধিবাসীদের জীবনযাত্রাকে খুব কাছ থেকে দেখে।
বর্তমান সময়ের নিরিখে অতি উন্নতমানের অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার সহজলভ্য সমস্তরকম সুবিধার হাতছানিকে অনায়াসে দূরে সরিয়ে রেখে, যে বিশ্বাস থেকেই অ্যামিশরা শতাব্দীপ্রাচীন অনাধুনিক পদ্ধতিতে জীবনযাপন করে থাকুক না কেন, সেটা যে নিতান্ত সহজ নয় তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনি যতই আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে থাকুন না কেন, তবুও হলফ করে বলা যায় একবারের জন্য হলেও অ্যামিশদের এই শান্ত জীবন আপনার যাপন করতে ইচ্ছে করবেই।
অ্যামিশদের উপত্যকা অতিক্রম করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় পেন্স কেভে। পাকদণ্ডী এই পথটুকু পেরোতে পেরোতে বরং গুহাটি সর্ম্পকে প্রচলিত লোককাহিনীটি শুনে নেওয়া যাক।
শোনা যায় বহুকাল আগে সেনেকা রেড ইন্ডিয়ানরা কারুণ্ডিহা ভ্যালিতে একটি গুহা আবিষ্কার করে। এরপর সেখানে সাত পুত্র এবং এক কন্যার পিতা ও-কো-চো’র দলপতিত্বে একটি গোষ্ঠী বসবাস শুরু করে। এইসময় মালাশিবোয়ে নামে ল্যাঙ্কাস্টার কাউন্টির এক ফরাসি যুবক জঙ্গল অভিযানে বেরিয়ে এসে পৌঁছায় ও-কো-চো’র এলাকায় ম্যামথ স্প্রিংয়ের কাছে। এখানেই ও-কো-চো’র সাথে বন্ধুত্ব হয় মালাশির এবং প্রণয় সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তার একমাত্র কন্যা নিতানির সাথে। কিন্তু গোষ্ঠীবহির্ভূত এই প্রণয় সম্পর্ক মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি দলপতির। তাই সেই দলপতির নির্দেশে তার ছয় পুত্র ফেরারি প্রেমিক-প্রেমিকাকে ধরে আনে এবং ওই গুহার জলে ফেলেই হত্যা করে মালাশিকে।
অবশ্য প্রাচীন লোককাহিনীর কথাই বা বলি কি করে? এখনও অনেক জায়গাতেই বলি প্রদত্ত হতে হয় প্রণয়সম্পর্কে আবদ্ধ বহু মানুষকে, কখনও জাতপাতের দোহাই দিয়ে, কখনও বা ধর্মের অজুহাতে।
Advertisement
যাই হোক, নিতানি-মালাশির গল্পটাতেই আবার ফিরে যাই। স্থানীয় মানুষের দাবি অনুযায়ী এখনও না কি গ্রীষ্মের রাতে নিতানির নাম ধরে একটি পুরুষকন্ঠের করুণ সুরের কান্না অনেকেই শুনতে পায়।
মালাশি হত্যাপর্বের পর কেটে গেছে বহু শতাব্দী। পরিবর্তন ঘটে গেছে অনেক কিছুর। কারুণ্ডিহা ভ্যালি পরিণত হয়েছে পেন্সভ্যালিতে। সেনেকা রেড ইন্ডিয়ানদের বসবাসের গুহা এখন হয়েছে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান। ১৮৮৫ সালে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া পেনসিলভেনিয়ায় আমেরিকার একমাত্র জলপূর্ণ (all-water) কেভ। তাই গুহার ভেতরটা দেখার একমাত্র উপায় হল নৌকা। আর তার ভেতরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দূর করার উপায় হল একটিমাত্র টর্চের আলো এবং কোনও কোনও স্থানে কম পাওয়ারের বিজলি বাতি। এতটুকু অপব্যবহার নেই বিদ্যুতের। তাই কেবল প্রয়োজনীয় অংশগুলিতেই রয়েছে আলোর ব্যবস্থা। অবশ্য কিছুটা গা ছমছমে পরিবেশ বজায় রাখার জন্যও তা করা হয়ে থাকতে পারে।
কিছুটা ঢালু পথ আর সিঁড়ি ভেঙে গুহার ভিতরে জলের কাছে পৌঁছতে হয় যেখানে গাইড অপেক্ষা করে খুব সরু একটা নৌকা নিয়ে। ওপর থেকে নিচে নামার সময় গুহামুখ দেখে মনেই হবে না যে তার ভিতরটা এত ভয়ানক অন্ধকার এবং কোথাও কোথাও এতটাই সংকীর্ণ যে বোটের মধ্যে বসে থাকা অবস্থাতেও এবং মাথাটাকে যথাসম্ভব নিচু করার পরেও মনে হয় এই বুঝি আর শেষরক্ষা হলো না।
গুহার মধ্যে ডিমের পোচ
ভূবিজ্ঞানীরা বলেন, বাতাসে মিশে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইডের সাথে বৃষ্টির জল মিশে মৃদুকার্বনিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যাসিডযুক্ত বৃষ্টির জল বহু বছর ধরে আস্তে আস্তে পাহাড়ি এলাকার মাটির সাথে থাকা স্বচ্ছিদ্র চুনাপাথেরর সঙ্গে মিশে পাহাড়ের গায়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করে, তা থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন আকারের শিলামূর্তি। ভৌগোলিক পরিভাষায় এই গুহাক্ষতগুলোর নাম স্ট্যালাগমাইট (গুহার মেঝেতে তৈরি হওয়া ধারালো অস্ত্রের মতন আকার যার ছুঁচালো মুখ থাকে উপরদিকে) ও স্ট্যালাকটাইট (গুহার ছাদে তৈরী হওয়া অস্ত্রের মতন আকার যার ছুঁচলো মুখ থাকে নিচের দিকে)। তা সে যাই হোক না কেন, আমার চোখে কোনওটা কেশর কুলফি তো কোনওটা ডিমের পোচ।
কল্পনাপ্রবণ মনটাকে যদি আরও কিছুটা ছাড় দেওয়া যায় তাহলে অনবরত মন্থরগতিতে নির্ণয়মান এই প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে অনায়াসে মিলিয়ে নেওয়া যায় বিভিন্ন দেবদেবী বা পশুপক্ষীর সঙ্গে। এভাবেই কল্পনার জাল বুনতে বুনতে, যাত্রাপথের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারকে কাটাতে কাটাতে, এবং প্রয়োজনীয় অংশগুলিকে বুঝে নিতে নিতে আমাদের বোট যখন গুহার অপরপ্রান্তে পৌঁছলো, তখন মনে হল যেন অন্ধকার রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটলো। যদিও ঘড়ির কাঁটার নির্দেশ অনুযায়ী সময় বলছিল বিকেল চারটে। আর সেই পড়ন্তবেলায় দেখতে পাওয়া যায় দূরে বন্যপশুরা সারবেঁধে জল খেতে আসছে। এই সমস্ত বন্যপশু, যেমন এল্ক, লংহর্ন, বাইসন, এবং বিভিন্ন প্রজাতির হরিণদের নিয়ে এখানে একটা ওয়াইল্ডলাইফ পার্কও আছে।
অন্ধকারের পূর্বমুহূর্ত
গুহার মধ্যে যাতায়াতের এই ৪৫ মিনিটের প্রতিটি মুহূর্তই বেশ রোমাঞ্চকর হলেও মাঝখানের কিছুক্ষণ যখন টর্চের আলোটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সেই নিকষ কালোর মাঝে পাশে বসা মানুষটার অস্তিত্বকেও অনুভব করা যায় না। চোখ বন্ধ আর খুলে রাখার অনুভূতির মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। সমস্ত স্থান জুড়ে তখন পূর্ণমাত্রায় নিস্তব্ধতা বিরাজ করে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’। ঠিক সেই কয়েক মুহূর্তের অনুভূতি অবর্ণনীয়।
ভৌতিক রোমাঞ্চকর গাছমছমে কোনও পরিবেশ বজায় রাখার জন্য, না কি মানব হৃদয়ের অন্তরে লালিত প্রকৃত প্রেমের চিরন্তনতাকে পূর্নতা দেবার অনন্তকালীনঅবদমিত বাসনা থেকেই মালাশি’র কান্নার এই কাহিনির জন্ম হয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল আর মানুষের বুদ্ধির কৌশলের মেলবন্ধনে যে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর জগৎ সৃষ্টি হয়েছে গুহার মধ্যে তা মনকে ছুঁয়ে যায়।
ছবি: লেখক