স্বঘোষিত বৈজ্ঞানিক কেসি পাল এবার ছবির পর্দায়, মুক্তি পেল ট্রেলার
কলকাতা: এই শহরে থেকে কেসি পালের নাম শোনেননি এমন বাঙালি বোধহয় পাওয়া যাবে না। অন্তত তিরিশোর্ধ বয়স যাদের তাঁরা তো নিশ্চয়ই চিনবেন সেই অদ্ভুত থিওরিতে বিশ্বাসী ‘বৈজ্ঞানিক’টিকে। কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় তাঁর হাতে লেখা বিজ্ঞপ্তি ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’ দেখে একটা গোটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। যতই পাগলামি মনে হোক, এটা মানতেই হবে এই তথ্য সর্বসমক্ষে পেশ করার মধ্যে এক অদম্য জেদ ছিল তাঁর। মানুষের শত কটাক্ষ, হাজারো উপহাসেও তিনি দমে যাননি। বরাবর বিশ্বাস করে গেছেন পৃথিবী নয়, বরং সূর্যই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
কেসি পালের জীবনের এই অভিনব ঘটনা অবলম্বনে গত বছর ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন পরিচালক অরিজিৎ বিশ্বাস। পরিচালক হিসেবে এটা তাঁর প্রথম কাজ হলেও এর আগে বহু ছবির জন্য কলম ধরেছেন অরিজিৎ। সম্প্রতি শ্রীরাম রাঘবনের ‘অন্ধাধুন’ ছবির চিত্রনাট্যের জন্য জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’র জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন গতবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। এছাড়া সেরা ছবি হিসেবে পুনে চলচ্চিত্র উৎসবে চলতি বছরেই পুরস্কৃত হয়েছে এই ছবিটি।
‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’র বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শ্রীলা মজুমদার, পল্লবী চট্টোপাধ্যায়, কবির সুমন, বিমল চক্রবর্তী, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পবন কানোরিয়া ও সূচন্দ্রা বন্যা। গতকাল শহরে এক অনুষ্ঠানে মুক্তি পেল এই ছবির ট্রেলার। উপস্থিত ছিলেন ছবির শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
ছবিতে কেসি পালকে টিসি পাল নামে দেখা যাবে। ছবির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো চিরন্তন চ্যাটার্জী। চিরঞ্জিতকে দেখা যাবে এই চরিত্রে। চিরন্তন একসময় বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলেও এখন ঘরে বসে বিপ্লব করাকেই বেছে নিয়েছে। তবে কোথাও তিনি অপরাধবোধে ভোগেন সেই আদর্শকে ছেড়ে আসার কারণে।
‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’র আর একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো সঞ্জীব (অঞ্জন)। ইনিও একসময় বামপন্থী ছিলেন, কিন্তু জীবনযাত্রার কারণে নিজের আদর্শ থেকে এখন অনেকটাই সরে এসেছেন তিনি।
ছবির কাহিনী নিয়ে অরিজিৎ বললেন, “এই টিসি পাল লোকটি নিজেকে বৈজ্ঞানিক বলে পরিচয় দেন, আসলে তিনি একটু পাগলাটে ধরণের। তিনি যেটা বলছেন সেটা তো ভুলই, তাঁর কথার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু তিনি তাঁর বিশ্বাসে অবিচল, এবং এদেরকে ঘিরেই নানান রাজনৈতিক টানাপোড়েন দেখা যাবে ছবিতে। এখানে মূলত তিনটি চরিত্র, একজন নিজের বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন, আরেকজন কিছুটা বিভ্রান্ত এবং তৃতীয় মানুষটি তাঁর পুরোনো বিশ্বাস থেকে সরে এসেছেন। এই তিনটি চরিত্রকে নিয়েই ছবি।”
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ছবিতে কেসি পালের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, যেহেতু তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনা এই ছবিতে রাখা হয়নি, বরং একটা বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ছবিতে তুলে আনা হয়েছে তাই এখানে একটু অন্যভাবে চরিত্রটাকে দেখাবার প্রয়োজন ছিল। কেসি পালের ব্যক্তিগত জীবনকেও এখানে অন্যভাবে দেখানো হয়েছে।
টিসি পালের ভূমিকায় অভিনয় করছেন মেঘনাদ। “ছবিতে এই লোকটিকে ঘিরে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটা উঠে এসেছে,” জানালেন তিনি। “একজন মানুষ যে রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী সেটা ঠিক হোক বা ভুল হোক, সেই বিশ্বাসটা কতটা খাঁটি সেটাই এখানে মূল প্রতিপাদ্য। অর্থাৎ এখানে টিসি পালের ঘটনা একটা রূপক। এই ঘটনার পাশাপাশি চলবে একটা সমকালীন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ, কিভাবে মানুষ নিজের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে তার গল্প। আমি বরাবর মঞ্চেই বেশি কাজ করেছি। এত বড় চরিত্র কোনও সিনেমায়, এর আগে আমাকে কেউ দেননি। ছবির গল্পটা এতটাই অভিনব, আমার বিশ্বাস দর্শকদের ভালো লাগবে।”
আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে
চিরঞ্জিত জানালেন, “আমার চরিত্রটা একজন সুপারস্টারের। সে ছবির জন্য বিষয় খুঁজছে। ছবিতে সঞ্জীব আমার বন্ধু। ও চিত্রনাট্য লেখে আর আমি ছবি করি। টিসি পালকে দেখে ওর মাথায় একটা গল্প আসে। আমরা দুজনেই দেখতে যাই এই মানুষটি যেটা বলছে সেটার আদৌ কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না। তার সঙ্গে কথা বলে আমরা বুঝলাম, সে যা বলছে সেটা পুরোপুরি মিথ্যা। তখন চিরন্তন আর সঞ্জীব দুজনেই বেরিয়ে আসে প্রজেক্টটা থেকে। কিন্তু এই লোকটি যে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে, এটা কোথাও যেন চিরন্তন আর সঞ্জীবের জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। নিজেদের অতীত জীবনের ফেলে আসা সত্বার মুখোমুখি যেন দাঁড় করিয়ে দেয় টিসি পাল।”
ছবিতে টিসি পালের স্ত্রীর চরিত্রে রয়েছেন শ্রীলা। “আমার কেরিয়ারের গোড়ার দিকে যে ধরণের চরিত্রে কাজ করেছি—যে ছবিগুলো আমাকে শ্রীলা মজুমদার বানিয়েছে—আমার মনে হয়েছে এটা সেরকমই একটা ছবি। একজন মানুষ তাঁর বিশ্বাসের জন্য সারাজীবন লড়ে যান, তাঁর পাশে থেকে সেই লড়াইটা দেখা এবং শুরুর দিকে সবরকমভাবে সাহায্য করা, চরিত্রটা সবদিক দিয়েই ভালো লেগেছিল আমার। খুব তৃপ্তি পেয়েছি কাজ করে।”
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
ছবিতে সঞ্জীবের স্ত্রীর ভূমিকায় রয়েছেন পল্লবী। “অনেকদিন পরে একটা ভালো চরিত্র পেলাম,” বললেন তিনি। “এখনই সবটা বলবো না তবে এই চরিত্রে আমাকে দেখে দর্শক কিছুটা হলেও চমকে যাবেন।”
ছবির কাহিনী লিখেছেন অরিজিৎ ও পারমিতা মুন্সি, সঙ্গীতের দায়িত্বে রয়েছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রগ্রহণ করেছেন শীর্ষ রায়।
২৯ নভেম্বর মুক্তি পাবে ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’।