দেবতার গ্রাস

ধর্মভীরু মানুষের প্রথম ও শেষ আশ্রয় দেবালয় বা মন্দির। জীবনের সমস্ত শোক, দুঃখ, তাপ, মানুষ ঈশ্বরের হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। ঈশ্বরের কাছাকাছি থাকতে পারাকে হিন্দুধর্মে অতি পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়। এই ধারণাকে অবলম্বন করে যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের বুকে চলে আসছে দেবদাসী প্রথা।

ঈশ্বরের চরণে আশ্রিত হয়ে তাঁর সেবা ও মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করাই দেবদাসীদের ধর্ম। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী দেবদাসী হলো মন্দির তথা ঈশ্বরের সেবিকা। পুরোহিত ও নগরের অভিজাত শ্রেণী দ্বারা নিযুক্ত হতো দেবদাসীরা। উদ্দেশ্য মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন ও নানান শিল্পকর্মের দ্বারা ঈশ্বরের মনোরঞ্জন। দেবদাসীদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, পূজা সংক্রান্ত নানান কাজ ও পূজা মণ্ডপে নৃত্য ও গীত পরিবেশন করা। ধর্মীয় শোভাযাত্রাতেও এদের দেখা যেত। পূজার সময় দেবমূর্তিকে বাতাস করার দায়িত্ব ছিল দেবদাসীদের।

এ তো গেল নিয়মের কথা, দেবদাসী বলতে যা বোঝানো হতো তার কথা। কিন্তু ব্যাপক অর্থে দেবদাসী বলতে বোঝায় মন্দিরের সেবিকার আড়ালে সমাজস্বীকৃত বারাঙ্গনা বা গণিকা।

কালিদাসের মেঘদূত, কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র, বা বাৎস্যায়নের কামসূত্র গ্রন্থে প্রাচীনকালের দেবদাসী প্রথা সম্পর্কে জানা যায়। সেই যুগে যারা দেবদাসীর কাজ থেকে অবসর নিতেন, তাদের মন্দিরের কর্তৃপক্ষ পশম ও তুলো বাছাইয়ের কাজে নিযুক্ত করতো, একথা কৌটিল্য লিখেছেন। বহু ক্ষেত্রে দেবদাসীদের নিঃসন্তান পরিবারে বংশরক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হতো। এক্ষেত্রে যেহেতু সেই সব মহিলারা মন্দিরের জন্য উৎসর্গীকৃত, তাই তাদের উপর সমাজের অভিজাত মহলের অলিখিত অধিকার থাকতো। অর্থাৎ ঈশ্বরের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার পর মন্দির যেভাবে তাদের পরিচালনা করতো তাদের সেই নির্দেশ মেনে চলতে হতো। সেক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম থাকতো না। এই দেবদাসীরদের গর্ভজাত সন্তানরা ভবিষ্যতে পিতার পদবী ও বংশমর্যাদা বহন করতো। বলা বাহুল্য, মাতার পরিচয় সমাজে গ্রাহ্য হতো না।

যে আগুন নেভে না

তবে প্রাচীনকালে দেবদাসীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। পুরোহিতের পরেই সমাজে স্থান ছিল দেবদাসীদের। এমনকি স্বাধীনতার অনেক পরে অবধিও কর্ণাটক, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের অনেক মন্দিরে ও উড়িষ্যাতেও দেবদাসী প্রথার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। দক্ষিণ ভারতের চোল, চেল, ও পান্ড্য বংশের আমলে এই প্রথা প্রধানত শুরু হয় বলে জানা যায়। প্রায় তিন লক্ষ দেবদাসী নিযুক্ত ছিল সেই সময়ের বিভিন্ন মন্দিরে। ভারতের বাইরে নেপালেও দেবদাসী প্রথার প্রচলন ছিল। বলা হয়ে থাকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিজেকে নিবেদন করতেন মূলত নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে। সেখান থেকেই দেবদাসীদের মন্দিরের নর্তকীরূপে নিযুক্ত করার ভাবনা আসে।

সে সময় পুরুষদেরও এই প্রথার অন্তর্ভুক্ত করা হতো, অর্থাৎ নর্তকদেরও একই কাজে নিযুক্ত করার রেওয়াজ ছিল। মনে করা হয়, প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যসমূহ যেমন ভরতনাট্যম, ওড়িশী এইসবই এককালে দেবদাসীদের দ্বারা মন্দিরে প্রদর্শিত হতো। ওড়িশায় দেবদাসীদের বলা হতো ‘মাহেরী’। বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো এদের। কর্নাটকে ‘বৈসিভি’, অন্ধ্রপ্রদেশে ‘যোগিনী’, মহারাষ্ট্রে ‘মাতাঙ্গী’, গোয়ায় ‘ভাভিন’ নামে পরিচিত ছিল দেবদাসীরা। শৈশবেই দেবতাকে স্বামীরূপে বরণ করে আজন্ম সেবা করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হতো এদের কাছে। এদের প্রধান কাজ ছিল নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে দেবতাকে আনন্দদান করা।

কিন্তু এই প্রথার আড়ালে চলতো পুরোহিতদের ঘৃণ্য লোভলালসার খেলা। মাহেরী বা দেবদাসীদের ভোগ করতো স্বয়ং মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ও অন্যান্য পুরোহিতরা। এরপর তার ওপর অধিকার ছিল সমাজের অভিজাত সম্প্রদায়ের। নৃত্যরত অবস্থায় দেবদাসীদের সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে দেবতাকে সাক্ষী রেখে মন্দিরের গর্ভগৃহে নিজের কামনাবাসনা চরিতার্থ করতো প্রধান পুরোহিত। ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটতে থাকলে দেবদাসী প্রথায় কিছুটা লাগাম পড়ে। পুরুষ নর্তক প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও পুরোপুরি রেহাই মেলেনি দেবদাসীদের। লুকিয়ে-চুরিয়ে চলতেই থাকে দেবসেবার এই নির্লজ্জ প্রথা। খুব বেশিদিন নয়, মাত্র তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও পুরীর কোনারক মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগ প্রথা চালু ছিল। যদিও সরকারি মত অন্য কথা বলে।

ঐতিহ্যের পুজো: রানী রাসমণি

দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক জেলার ইয়ালাম্মা মন্দিরে সৌন্দত্তি উৎসবের সময় হাজার হাজার দেবদাসী নিয়োগ করা নিয়মের মধ্যেই পড়তো। শিশুকন্যা, যাদের বয়স আট-নয় থেকে শুরু করে বারো-তেরোর মধ্যে, তাদের বিবাহ দেওয়া হতো দেবমূর্তির সঙ্গে। সেই সঙ্গে আজীবনকালের জন্য তাকে উৎসর্গ করা হতো ঈশ্বরের সেবার কাজে। সেই ঈশ্বরের সেবা যে কালে-কালে তাদের মৃত্যুমুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করবে সে কথা তাদের অভিভাবকরা জেনেও না জানার ভান করতেন। মূলত অর্থাভাব, ধর্মের আড়ালে পুরোহিত সম্প্রদায়ের শোষণ আবার কোনও ক্ষেত্রে সামাজিক স্বীকৃতি বা নিছক কন্যাসন্তান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কারণে সব জেনেও অভিভাবকরা মন্দিরে নিজেদের সন্তানকে উৎসর্গ করে যেতেন।

সেই শিশুকন্যা যখন নারীত্বে উত্তীর্ণ হতো তখন উৎসবের দিন এদের বিবাহের সাজে সজ্জিত করে হাতে ক্ষীরের পাত্র নিয়ে দেবতার মন্দিরের সামনে দাঁড় করানো হতো। চারপাশে অজস্র ভক্ত সমাগম হতো পবিত্র দেবদাসী প্রথা চাক্ষুষ করার জন্য। এরপর পাঁচজন পুরুষ তার হাত থেকে সেই ক্ষীরের পাত্র নেবার নামে তাকে বিবস্ত্র করেতো ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। এই হলো সংক্ষেপে দেবদাসী নিয়োগের নিয়ম। এরপর সেই পবিত্র নারী মন্দিরে প্রবেশ করবে। সামাজিক জীবনে ফিরে যাবার পথ তার কাছে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো ওই দিন থেকেই।

মন্দিরে প্রবেশ করার পর একদিকে যেমন তার উপরে দৈনন্দিন দেবসেবার ভার দেওয়া হতো, তেমনি অন্যদিকে প্রতিরাতে অবর্ণনীয় যৌন অত্যাচারের জন্যও তার নাম লেখা হয়ে যেতো। এখন থেকে সে মন্দিরের পুরোহিতের সম্পত্তি। প্রধান পুরোহিত যেমনভাবে ইচ্ছে ঈশ্বরের নামে তাকে ভোগ করবেন ও তার অনুমতিবলে অন্য পুরোহিত ও সমাজের অভিজাত সম্প্রদায়ও তাকে ভোগ করে যাবে প্রতিদিন। বিশ্বাস করা হতো দেবদাসীর সঙ্গে মিলিত হতে পারলে ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি যোগস্থাপন করা সম্ভব, বা ঈশ্বরকে খুশী করা সম্ভব। এভাবে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার দিয়ে দিনের পর দিন একটি মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা চলতে থাকতো।

অন্ধকারের দেবী

এমনভাবে প্রতিদিন বারোভোগ্যা হতে হতে একদিন হয়তো কোনও দুরারোগ্য কালব্যাধি আশ্রয় করবে তার দেহকে। তখন তার কোনও দায়িত্ব আর মন্দির কর্তৃপক্ষ নিতো না। অবশেষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের ঠাঁই হতো শহরের বেশ্যাপল্লীতে। যারা এই অবস্থায় পড়তেন না, তারা থেকে যেতেন মন্দিরেই। তাদের পুত্রসন্তানরা পরিচয়বিহীন হয়ে সমাজে বড় হতো যদি না কোনও অভিজাত বংশ তাদের গ্রহণ করতো। আর কন্যাসন্তান হলে আবারও এই এক ভাগ্যচক্রে তাদের জীবনও পিষতে থাকবে বলাই বাহুল্য।

দক্ষিণ ভারতের গ্রামগুলিতে এই প্রথা বহুল পরিচিত ছিল একসময়। ১৯৮৮ সালে সরকার কড়া আইন করে দেবদাসী প্রথাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করেছে বলা হলেও এখনও দক্ষিণের বহু মন্দিরে এই প্রথা চলছে। কোনারক মন্দিরেও বহুদিন পর্যন্ত এই প্রথা চলেছে বলে জানা যায়। পুরীর সমুদ্রের সঙ্গে মন্দিরের গর্ভগৃহের যে গোপন রাস্তা আছে সেখানে এখনও ছোট ছোট কুঠুরিতে বয়স্ক মাহেরীরা বাস করেন বলে শোনা যায়। এদের সম্পর্কে কোনও খবর বাইরে থেকে জানা সম্ভব নয়।

সরকারীভাবে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও উড়িষ্যায় দেবদাসী প্রথা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের অন্ধকার এখনও এই দেশের সর্বত্র শিক্ষার আলো পৌঁছতে দেয়নি। তাই এখনও বহু প্রাচীন মন্দিরে ঈশ্বরের নামে এই ঘৃণ্য প্রথা সাড়ম্বরে চলে আসছে বলে গোপন সূত্রে জানা যায়।

২০১৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে এখনও এই দেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় সাড়ে চার লাখ দেবদাসী এইভাবে জীবন ধারণ করে চলেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছে দক্ষিণ ভারতে। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত অপরিণত বয়সে অবাধ যৌনতার শিকার হওয়ার ফলে একসময়ে এইডস বা অন্যান্য কঠিন যৌনরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, অথবা পঙ্গু হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। সরকার শুধু আইন প্রণয়ন করে কর্তব্য রক্ষা করেছে। কিন্তু ধর্মের কঠিন বর্ম ভেদ করে দারিদ্র্যের অসহায়তাকে প্রতিদিন ধর্ষিত হবার হাত থেকে এখনও উদ্ধার করতে পারেনি। সমাজের উঁচুতলার মানুষ ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষের একচেটিয়া ক্ষমতা প্রদর্শন ও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে গরিব, অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষদের ওপর শোষণ সেদিনও যেমন ছিল আজও তেমনই রয়ে গেছে। মানুষের মনের অন্ধকার দূর হয়ে এই অবর্ণনীয় প্রথার অবলুপ্তি কবে ঘটবে তা এখনও অজানা।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
4621

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

3 thoughts on “দেবতার গ্রাস

  • অসাধারণ লেখা

    Reply
  • ভীষণ ভাল লিখেছিস।

    Reply
  • You’ve opened a naked truth! Really so horrible & pathetic culture of religious India! Shame on those priests!!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *